ভ্রমণ
পান খেতে মহেশখালী
লেখা ও ছবি সুমন্ত গুপ্ত
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘যদি সুন্দর একটা মুখ পাইতাম, মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম’ এ রোমান্টিক গান দিয়েই বোঝা যায় পান একটি শৌখিন খাবার। এক সময় আমাদের দেশে ঘরে ঘরে দাদা-দাদি, নানা-নানি বয়স্করা পান খেতেন। আর এখন সব বয়সের নারী-পুরুষ শখের বসে পান খেয়ে থাকে। কেবল স্বভাব হিসাবেই নয়, বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসাবেই পানের ব্যবহার চলে আসছে। আর এ পান খেতে আমি আর আমার ভ্রমণ সঙ্গী সানন্দা মহেশখালীর পথে। বর্তমানে আছি কক্সবাজারে। ঘড়ির কাঁটায় আটটা বাজতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। কলাতলী থেকে ব্যাটারিচালিত অটোতে করে গেলাম কক্সবাজার ৬ নাম্বার ঘাটে। সেখানে লোকজন যে যার মতো গন্তব্য পথে যাচ্ছে, কেউ আবার ফিরছে শহর পানে। আমরা এগিয়ে চললাম, আমি আবার সাঁতার জানি না তাই নদীপথে যে কোনো গন্তব্যে ভীতি কাজ করে আমার। এর পরও মহেশখালীর পান খাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম জেটির দিকে। আগের থেকে অনেকেই বলেছিল মহেশখালী জেটিতে ওঠানামা করা কষ্টকর তার প্রতিফলন দেখলাম। বেশ কায়দা করে উঠে পড়লাম স্পিড বোটে। এবার সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার পালা। সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে আমাদের স্পিড বোট এগিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে সমুদ্রের নোনা জল স্পর্শ করছে।
ইতিহাসবিদদের ধারণা, দক্ষিণ এশিয়ার আধিবাসীরা পান খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করেন হাজার বছর আগে থেকেই। পান যে অত্র অঞ্চলের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জানা যায় ভারতবর্ষের রাজা, সম্রাটদের অন্দর মহলেও পান খাওয়ার প্রচলন ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা স্ত্রী নূরজাহানের পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল এবং তিনি তা অন্দর মহলের অন্যদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন। বাংলাদেশে উৎপাদিত বাংলা, মিঠা, সাচি, কর্পূরী, গ্যাচ, নাতিয়াবাসুত, উজালী, মহানলী, চেরফুলী, ভাবনা, সন্তোষী, জাইলো, ভাওলা, ঝালি, প্রভৃতি জাতের মধ্যে মহেশখালীর মিষ্টি পান উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। এখানকার অধিবাসীদের অন্যতম সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পেশা পান চাষ।
ড. ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণকাহিনি থেকে জানা যায়, ২০০ বছরের অধিককাল আগেও মহেশখালীতে পানের চাষ হতো। তিনি ১৭৯৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির বোর্ড অব ট্রেডের নির্দেশে চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা ভ্রমণ করেন। কক্সবাজার ভ্রমণকালে মহেশখালী দ্বীপে পানচাষিদের দেখতে পান। মহেশখালীর উঁচু পাহাড়ি জমি যেখানে পানি জমে না, সেসব জায়গায় তিনি পানের বরজের দেখা পান। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালার কক্সবাজার সিরিজে মহেশখালীতে তার ভ্রমণের বিবরণ আছে। তিনি লিখেছেন, ‘ভোরবেলা আমি দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পাহাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত পরীক্ষার জন্য বের হলাম।... আদিগঞ্জ (বর্তমান গোরকঘাটা) থেকে আনুমানিক এক মাইল পশ্চিমে ডুমসাগাকাতালু নামে পরিচিত একটি উঁচু ভূমি রয়েছে, যার প্রান্ত বৃষ্টির পানি চলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ঢালু এবং যার মাটি অত্যন্ত ভালো। পানির অভাবে এ জমিতে চাষাবাদ হয়নি, তবে তার এক জায়গায় একটি পানের বরজ বা বাগান রয়েছে।’ আমরা এসে পৌঁছালাম মহেশখালী জেটিতে। মহেশখালী জেটিতে মিষ্টি পান প্রতি খিলি ২০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। পর্যটকরাও এ আকর্ষণীয় মিষ্টি পান খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।
আমরাও এক খিলি পান কিনে মুখে পুরলাম। বাজারে ৫ টাকায় পান পাওয়া গেলেও তাদের পানের কী বিশেষত্ব, জানতে চাইলে রহিম উদ্দিন ও নিজামউদ্দিন নাইম জানান, তারা পানে বিশেষ কিছু মসলা ব্যবহার করে থাকেন। এগুলো আসে ভারত থেকে। সবচেয়ে কম দামি পানেই তারা প্রায় ২০ ধরনের মসলা ব্যবহার করেন। যেমন নারকেল, কিশমিশ, বাদাম, ধনিয়া, মিষ্টি জিরা, তিল ইত্যাদি। অন্যান্য পানে ব্যবহার করা হয় আরও অনেক মসলা। যেমন-পেস্তা, গোলাপের পাপড়ি, জ্যষ্টিমধু, কাজুবাদাম। আর ১০০ টাকার পানে দেওয়া হয় ৪০ রকম মসলা। যার মধ্যে জাফরান ও কস্তুরি থাকে। পানের দাম যত বেশি, মসলা তত বেশি। মহেশখালী জেটিতে এক মিষ্টি পান বিক্রেতা জানালেন, তিনি শুধু মিষ্টি পানই বিক্রি করেন। স্থানীয়দের জন্য পান বিক্রি করেন না। পর্যটকদের কাছে যে পান বিক্রি করা হচ্ছে তা স্থানীয় লোকজন এত দাম দিয়ে খায় না। মহেশখালীতে আসা অধিকাংশ পর্যটকই অন্তত এক খিলি হলেও পান খায়। অনেকেই প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার জন্য কয়েক খিলি পান নিয়ে যায়। প্রতিদিন ৬-৭ হাজার টাকার পান বিক্রি হয়। আরেকটি বিশেষত্ব হলো, এসব পানে সুপারি ও চুন দেওয়া হয় না। আর এ পান মুখে দিলে সর্বোচ্চ দুই মিনিট থাকবে। চলতি পথে কথা হয় এক ক্রেতার সঙ্গে তিনি জানান, নিজের হাতেই মহেশখালী থেকে পান কিনে আনেন। আর সুপারি কেনেন কক্সবাজার থেকেই। পানে তিনি নারকেল, কিশমিশ, বাদাম, ধনিয়া, মিষ্টি জিরা, তিলসহ ১০ থেকে ১২ ধরনের মসলা ব্যবহার করেন। অনেক দোকানে পানের সঙ্গে কেন সুপারি ব্যবহার করে না, আর দাম কেন এত বেশি-জানতে চাইলে জবাবে তিনি বলেন, কথায় আছে না-পান খাইলে সুপারি লাগে আরও লাগে চুন। পানের সঙ্গে সুপারি আর চুন না হলে পান খাওয়াই বৃথা। তবে দামের কথায় নিরুত্তর থাকেন আবুল শামা। কক্সবাজারে এ রকম অনেক দোকান আছে যেখানে মজাদার মহেশখালীর রসালো পান বিক্রি হয়।
কথা হচ্ছিল মমতাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্ষার সময় পানের ফলন ভালো হয়, তাই এ সময় দাম কম থাকে। শীত ও বসন্তকালে ফলন কমে যায়, তাই দাম বেশি থাকে। সাধারণত পান বিক্রি হয় গণ্ডা বা বিড়া হিসাবে। চারটি পানপাতায় এক গণ্ডা এবং ৮০ গণ্ডায় এক বিড়া ধরা হয়। প্রতি বিড়া পান কমপক্ষে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পানের ওজন গুরুত্বপূর্ণ। এক বিড়া পানের ওজন সাধারণত ৩০০-৪০০ গ্রাম হয়। মমতাজুল ইসলাম জানান, গোরকঘাটা ও বড় মহেশখালীর নতুনবাজারে সপ্তাহের মঙ্গল ও শুক্রবার পানের হাট বসে। চাষিরা বরজ থেকে পান তুলে বাঁশের ঝুড়িতে গোল করে সাজিয়ে হাটে নিয়ে আসেন। হাটবারে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আড়তদাররা এসে জড়ো হন মহেশখালীতে। তারা পান কিনে ট্রাকে বা বড় নৌকায় করে নিয়ে যান। খিলি পানের জন্য গোরকঘাটার মিষ্টিমুখ হোটেলের পাশের দোকানটি প্রসিদ্ধ। তিনি আরও জানান, মহেশখালীর সব বাগানের পানের স্বাদ এক নয়। পাহাড়ের পাদদেশের পুরোনো বাগানের পানই বেশি স্বাদের। নতুন বাগানের পান কিছুটা কম স্বাদের। তবে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার পানের তুলনায় মহেশখালীর সব বাগানের পানের স্বাদই অতুলনীয়।
