জীবনে এগিয়ে চলতে বন্ধুর প্রয়োজন
সাঈদুজ্জামান সৈকত
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশেই বন্ধু দিবসের প্রচলন শুরু। ১৯৩০ সালে এ দিবস শুরু করেছিলেন বিশ্বখ্যাত উপহারসামগ্রী ও কার্ড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হলমার্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জয়েস হলো। তিনি প্রতি বছর ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধু দিবস উদযাপনের বিষয়টি সামনে আনেন এবং এদিন কার্ড আদান-প্রদানের মাধ্যমে বন্ধু দিবস পালন করার চল শুরু হয়। তবে তার সে প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি। কারণ, ১৯৪০ সাল নাগাদ মানুষ বুঝতে পারে, এটা কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নয়, বরং হলমার্কের কার্ডের ব্যবসা বাড়ানোর ফন্দি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধু দিবস উদযাপন অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। তবে জয়েস হলের উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রে হালে পানি না পেলেও ইউরোপ-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এক সময় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বন্ধু দিবস উদযাপনের প্রচলন। তবে এ দিবস উদযাপনের মোড় ঘুরিয়ে দেন প্যারাগুয়ের চিকিৎসক র্যামন আর্থেমিও ব্রেচ। তিনি ১৯৫৮ সালের ২০ জুলাই বিশ্বব্যাপী বন্ধু দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। এরপর বিশ্বব্যাপী গঠন করা হয় ‘বন্ধুত্ব ক্রুসেড’। এরপর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ৩০ জুলাইকে বন্ধু দিবস ঘোষণা করেন। জাতিসংঘ জুলাইয়ের ৩০ তারিখ বন্ধু দিবস পালন করলেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস হিসাবে পালিত হয়।
বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে পৃথিবীজুড়ে। আসলে জীবনে এগিয়ে চলার জন্য বা বড় হওয়ার জন্য বাবা-মা বা শিক্ষার যেমন অবদান রয়েছে, তেমনি একজন ভালো বন্ধুর মাধ্যমেও জীবনে এগিয়ে চলা যায়। তাই জীবনে বড় হওয়ার পেছনে একজন ভালো বন্ধুর প্রয়োজন রয়েছে।
ভালো বন্ধুর যত গুণ
বিখ্যাত সমাজসেবক হেলেন কেলারের কথা মনে আছে? যিনি বলেছিলেন, একাকী আলোয় হাঁটার চেয়ে একজন বন্ধুর সঙ্গে অন্ধকারে হাঁটা উত্তম।
আসলে সব নিয়ম-অনিয়ম, বিশ্বাস, নির্ভরতা আর বাঁধভাঙা সম্পর্কের মিলনস্থল হচ্ছে বন্ধু। বন্ধু কখনো শিক্ষক, কখনো সব দুষ্টুমির একমাত্র সঙ্গী। কিংবা মনের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, আবেগ আর ছেলেমানুষী হুল্লোড়ের অপর নামই বন্ধুত্ব। চলার পথে যে সম্পর্কে থাকে না জাতিভেদ, যে সম্পর্ক থাকে সব বাঁধনের ঊর্ধ্বে। অর্থ দিয়ে কেনা যায় না বন্ধুত্ব, কিংবা গায়ের জোরেও হয় না বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের জন্য চাই শুধু গুণ। আসুন জেনে নিই একজন ভালো বন্ধুর কিছু গুণাবলি।
প্রতি মুহূর্তের স্বতঃস্ফূর্ততা
দুজন মানুষকে পাশাপাশি রেখে বন্ধু হতে বললে বন্ধুত্ব হয় না। প্রেমের মতোই বন্ধুত্বও সাবলীল এবং স্বতঃস্ফূর্ত। ফলে প্রিয় বন্ধুরা কখনোই একসঙ্গে চুপচাপ থাকে না। তারা প্রাণবন্ত এবং উচ্ছল থাকে। যদি কথাই বলতে ইচ্ছা না করে তাহলে সেই বন্ধুত্ব না করাই ভালো।
বন্ধুত্ব চিরকালের
প্রিয় বন্ধু চিরদিনের। হতে পারে দুজনে আলাদা কলেজ গিয়েছেন, আলাদা শহরে জীবনযাপন করেন, প্রাত্যহিক জীবনের নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু এত কিছুর পরও ভালো বন্ধুত্ব কখনোই হারিয়ে যায় না। দুজন ভালো বন্ধু কখনোই একে অপরকে ভুলে যাবে না, বরং আরও বেশি করে একে অপরকে মনে করবে এবং সময় পেলেই একে অপরের সঙ্গে দেখা করে খুনসুটি করবে। রাগ অভিমান করে পরস্পরকে ভুলে গেলে সেটা কখনোই প্রকৃত বন্ধুত্ব নয়। যে কোনো উপায়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং মনের ভাব আদান-প্রদান করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বকে জিইয়ে রাখতে হয়।
বন্ধুত্বে বিশ্বস্ত থাকা
কথায় আছে বিশ্বাস ভালোবাসার শক্তি। আর বন্ধুত্বে বিশ্বাস রক্ষা করা খুবই জরুরি। তৃতীয় কোনো পক্ষের কথার সূত্র ধরে বন্ধুত্বের বিশ্বাসভঙ্গ কখনোই কাম্য নয়। প্রকৃত বন্ধুকে এ বিষয়টি সব সময় মাথায় রাখতে হয়, তবেই তো প্রকৃত বন্ধুত্ব হয়।
দুঃসময়ে পাশে থাকা
এক বন্ধুর বিপদে চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই অন্য বন্ধুর সাড়া দেওয়াই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয়। প্রয়োজনে সময়ে অসময়ে বন্ধুর বিপদে তাকে সাহায্য করা। যে বন্ধুর জন্য আপনি এমন করতে পারবেন এবং যে বন্ধু আপনার পাশে সর্বদা থাকতে পারবে, সে-ই আপনার সত্যিকার বন্ধু।
বন্ধুত্বের ইচ্ছাকে সম্মান জানান
বন্ধুর ইচ্ছাকে সব সময় সম্মান জানান উচিত। যদি তা পছন্দ না হয়, তবে সরাসরি বলুন। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা অবশ্যই জরুরি। সমালোচনা করুন, তবে কটূক্তি নয়। তবে সমালোচনার ভাষা ব্যবহারে সচেতন হওয়া খুবই প্রয়োজন। একবার ভুল হলে তাকে ছুড়ে না ফেলে তা শুধরে নেওয়াই প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব। বন্ধুর প্রতি বিনয়ী হওয়া বন্ধুত্বের প্রধান হাতিয়ার।
বন্ধুর প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়া
ভালো বন্ধু সব সময় বন্ধুর ভালো চায়। নিজের ভালো হোক সবাই চায়, তবে তার জন্য বন্ধুর ক্ষতি হোক এমন ভাবা কিন্তু প্রকৃত বন্ধুর পরিচায়ক নয়। প্রকৃত বন্ধু চাবেন তার নিজের উন্নতির পাশাপাশি আপনারও উন্নতি হোক। যেখানে কিংবা যত দূরেই থাকুন না কেন, বন্ধুর কল্যাণ কামনাই প্রিয় বন্ধুর পরিচায়ক।
বন্ধুত্বে সৎ থাকা
বন্ধুত্বে অবশ্যই সৎ থাকতে হবে। মিথ্যা তথ্য কিংবা ধারণা দিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়া যায়, গড়লেও তা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আপনি যা সেটাই প্রকাশ করা এবং অযথা কৃত্রিমতা বর্জন করে নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বন্ধুর কাছে স্বচ্ছ ধারণা তুলে ধরাই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব। মনের মতো বন্ধু পেতে সততার কোনো বিকল্প নেই। সততা প্রিজারভেটিভ ছাড়াই সম্পর্কের বৃক্ষকে সতেজ রাখে।
বন্ধুকে সময় দেওয়া
দীর্ঘদিনের বন্ধুরা একে অন্যের পেছনে সময় ব্যয় করে। মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রতিনিয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। বন্ধুরা হয়তো আগের মতো সময় দিতে পারে না। এর ফলে যে দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কের ব্যাঘাত ঘটবে তা কিন্তু নয়। নতুন বন্ধুদের পাশাপাশি পুরোনো সম্পর্কগুলোকে ঝালাই করে নিতে হয় প্রতিনিয়ত। দৈনন্দিন ব্যস্ততায় পুরোনো বন্ধুত্বকে হারিয়ে ফেলা একদমই উচিত নয়। আপনার বন্ধু আর আপনার মাঝখানে কেবল এক মুঠোফোন দূরত্ব। বন্ধুকে মনে করুন, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করুন।
ভালো শ্রোতা হওয়া
বন্ধুত্বে ভালো শ্রোতা হওয়াও খুব জরুরি। বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় কেবল নিজের কথাগুলোই প্রাধান্য দেওয়া উচিত নয়। বন্ধুকেও কথা বলতে দেওয়া এবং আলোচনায় উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে দুজনের ভালো লাগা, মন্দ লাগা পরস্পরের বুঝে নিতে সহজ হয়। বন্ধুর সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া, বন্ধুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ এমন বিষয় নিয়ে উপহাস না করাই প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব। বন্ধু মানেই কেবল আমার সবটুকু কথা তাকে বলে ফেলা নয়, বরং তার কথাগুলোকেও আপন করে নেওয়া।
বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখতে শেখা
বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা অনেক কঠিন কাজ। তবে একজন প্রকৃত বন্ধু সব সময়ই সম্পর্ককে প্রাধান্য দেন। তবে অনেকেই জানে না যে বন্ধুত্ব কীভাবে টিকিয়ে রাখতে হয়। ফলে কারণে-অকারণে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়, দূরত্ব তৈরি হয়, বন্ধুত্ব ক্রমেই হারিয়ে যায়। বিপরীতে যারা দীর্ঘদিন বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে চান তাদের থাকতে হবে স্বাভাবিকতা আর প্রাণচাঞ্চল্য। বন্ধুত্বের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি, রাগ, অনুরাগ, ব্যস্ততা, এড়িয়ে চলা, নার্ভাস ভাব ইত্যাদি দূরে রাখা শিখতে হয়।
