Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

নদীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মিতালি

Icon

শেখ আব্দুর রহিম

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পানির সঙ্গে কবিদের সম্পর্ক নিবিড়। পানির ছলছল শব্দে কবিমনে যে ছন্দের সৃষ্টি হয়, সে কথা কে না জানে! রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশের নাম এই ‘পানি’। পানিকে ভালোবাসতেন বলে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও স্থান পেয়েছে পানির প্রতি তার অনুরাগের কথা। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘পানির দেশের মানুষ আমরা। পানিকে বড় ভালোবাসি।’

পানির সঙ্গে কতটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল তা তার লেখা ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থে স্বহস্তে নৌকা চালানোর গল্পে, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে নদী নিয়ে আলোচনায় কিংবা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন রাজবাড়ীর পাংশা নদী খনন-এসব থেকে সহজেই পাঠকমনে স্পষ্ট ধারণা মেলে।

পিতা মুজিবের নদ-নদীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে ভোলেননি তারই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইয়ে তিনি লেখেন, ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলাবালি মেখে, বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে।’ হয়তোবা বঙ্গবন্ধুর নদীপ্রেমের সূত্র ধরে ২০ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি অন্নদাশঙ্কর রায় নদীর সঙ্গে মুজিবের সাদৃশ্যকরণ করতে ভুল করেননি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত তার লিখিত ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’ কাব্যগ্রন্থে ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের কবিতার প্রথমে লেখেন-‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।’

স্বাধীনচেতা এ মহান মানুষটির জীবনের শেষ থেকে শুরু অবধি ছিল পানির সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। পানি যেমন তার বিশুদ্ধতা আর পবিত্রতম ছোঁয়ায় সবকিছু শুদ্ধ করে তোলে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর জীবনও এ পানির ছোঁয়ায় নির্মল হয়ে উঠেছিল। পুণ্যভূমি টুঙ্গিপাড়ায় এখনো এমন অনেক খাল, বিল, পুকুর ও নদী-নালা রয়েছে-যেগুলো শেখ মুজিবের স্মৃতি বয়ে বেড়ায়। জোয়ারের উচ্ছ্ব¡সিত বেগ আর ভাটির নিুতা এখনো খুঁজে ফেরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে।

মধুমতি নদী : মধুমতি নদী গড়াই নদীর উপশাখা ও পদ্মার প্রশাখা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্র জীবনে এ নদীর সঙ্গে যতটা স্মৃতি রয়েছে, ততটা স্মৃতি নেই অন্য কোনো নদীর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে নদীটির অবস্থান। শুষ্ক মৌসুমে মধুমতির পানির প্রবাহ স্তিমিত হলেও বর্ষার সময় দুকূলে আছড়ে পড়ে স্ফীত ঢেউ। নদীটি দীর্ঘদিন এ এলাকার মানুষের যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হতো। সড়কপথ হওয়ার আগে তারা এ পথে লঞ্চ ও স্টিমারযোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গমন করতেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও বেশ কয়েক জায়গায় পাওয়া যায় এর প্রতিফলন। বইটিতে তিনি মধুমতির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে গল্পাকারে লেখেন,-‘আমি ও কাজী আলতাফ হোসেন সাহেব ঠিক করলাম, মওলানা শামসুল হক সাহেবের (যিনি এখন লালবাগ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল) সঙ্গে দেখা করব। মওলানা সাহেবের বাড়িও আমার ইউনিয়নে। জনসাধারণ তাকে আলেম হিসাবে খুবই শ্রদ্ধা করত। আমরা দুজন রাত দশটায় একটা এক মাঝির নৌকায় রওনা করলাম। নৌকা ছোট্ট, একজন মাঝি। মধুমতি দিয়ে রওনা করলাম। কারণ তার বাড়ি মধুমতির পাড়ে। মধুমতির একদিকে ফরিদপুর, অন্যদিকে যশোর ও খুলনা জেলা। নদীটা এক জায়গায় খুব চওড়া। মাঝে মাঝে সে জায়গায় ডাকাতি হয়, আমাদের জানা ছিল। ঠিক যখন আমাদের নৌকা সেই জায়গায় এসে হাজির হয়েছিল, আমি তখন ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পানির দেশের মানুষ নৌকায় ঘুমাতে কোনো কষ্ট হয় না। কাজী সাহেব তখনো ঘুমাননি। এ সময় একটা ছিপ নৌকা আমাদের নৌকার কাছে এসে হাজির হলো। চারজন লোক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করল, আগুন আছে কিনা? আগুন চেয়েই এ ডাকাতরা নৌকার কাছে আসে, এ তাদের পন্থা। আমাদের নৌকার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘নৌকা যাবে কোথায়?’ মাঝি বলল, টুঙ্গিপাড়া, আমার গ্রামের নাম। নৌকায় কে? মাঝি আমার নাম বলল। ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে ভীষণভাবে একটা আঘাত করে বলল, ‘শালা আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়।’ এ কথা বলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেল। মাঝি মার খেয়ে চিৎকার করে নৌকার হাল ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। মাঝির চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কাজী সাহেব জেগে ছিলেন, তার ঘড়ি, টাকা, আংটি সবকিছু লুকিয়ে ফেলেছিলেন ভয়ে। কাজী সাহেব শৌখিন লোক ছিলেন, ব্যবসায়ী মানুষ, টাকা-পয়সাও ছিল অনেক। আমি জেগে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী? কাজী সাহেব ও মাঝি আমাকে এ গল্প করল। কাজী সাহেব বললেন, ‘ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে, আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম, না হলে উপায় ছিল না।’ আমি বললাম ‘বোধহয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে। দুজনে খুব হাসাহাসি করলাম।’

নদীটিতে বর্তমানে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল বোট ল্যান্ডিং’ নামের দৃষ্টিনন্দিত ঘাট নির্মিত হয়েছে। প্রতিদিন শতশত দর্শনার্থী শেষ বিকালে এ ঘাটে নদীর পাড়ে সূর্যাস্ত দেখে সন্ধ্যার আবছা আলো গায়ে মেখে বাড়ি ফেরেন।

বাঘিয়ার নদী : বাঘিয়ার নদী মধুমতি নদীর শাখা নদী। এ নদীতে জড়িত রয়েছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। শিশু মুজিব এ নদীতেই সাঁতার কেটে, গোসল করে, বৈকালিক হাওয়া খেয়ে বড় হয়েছেন। দীর্ঘ কারাবাসের স্বল্পকালীন বিরতিতে যখন গ্রামের বাড়িতে ফিরতেন, তখন এ নদীর তীরে বসেই মন শান্ত করতেন। ঘাতকের হাতে শহিদ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে যখন হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়া আনা হয়েছিল, তখন তার কফিন যারা বহন করেছিলেন, তাদের একজন মরহুম মো. আবদুল হাই। ২০১৩ সালে তিনি জানিয়েছিলেন সেই মর্মান্তিক দিনের কথা। বলেছিলেন, এখনকার টুঙ্গিপাড়া থানা মসজিদের কাছে হেলিকপ্টার নেমেছিল। তারা পাঁচ-ছয়জন সেই কফিন বহন করেছিলেন। ‘কফিন ঘাড়ে করে নিতে নিতে বাঘিয়ার নদীর তীরে কফিনটি মাটিতে রেখে আমরা একদণ্ড দাঁড়িয়েছিলাম। হয়তো বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিমাখা বাঘিয়ার তীরে একদণ্ড থামতে। এছাড়া ১৯৭৪ সালে বাবা-মায়ের স্মরণে এক কুলখানিতে তৎকালীন গাজী রকেট স্টিমারে করে তিনি নামেন এ ঘাটে। স্থানীয়রা জানান, বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় শেষবারের মতো এ নদীপথে টুঙ্গিপাড়ায় আসেন।

হিজলতলা ঘাট : বঙ্গবন্ধুর বাড়ির একদমই পেছনে হিজলতলা ঘাটটির অবস্থান। বাড়ির এক কোণে থাকায় অনেক দর্শনার্থীর চোখে ঘাটটি ধরা পড়ে না। এ ঘাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ শেখ পরিবারের বড়-ছোট সবাই সে সময় গোসল করতেন। বাড়ির মহিলাদের জন্য মাটির কলসিতে করে গোসলের জন্য নেওয়া হতো এ ঘাটের পানি। ঘাটটির পাশে প্রাচীন হিজলগাছ থাকায় এর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে হিজলতলা ঘাট। পাশে থাকা হিজলগাছটি এত প্রাচীন যে, স্থানীয় প্রবীণ মানুষদেরও এর বয়স সম্পর্কে নেই কোনো সঠিক ধারণা। এ গাছটি থেকে বাল্যকালে দলবেঁধে বঙ্গবন্ধু ও তার বন্ধুরা পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালে লাফিয়ে পড়তেন। ২ কিলোমিটারবিশিষ্ট এ খালটি বাঘিয়ার নদী ও মধুমতি নদীর সংযোগ স্থাপন করেছে।

ছোট তালাব : তালাব মূলত হিন্দি শব্দ। যার বাংলা অর্থ পুকুর। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন দুটি তালাব। ছোট তালাব ও বড় তালাব। ছোট তালাব বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে প্রবেশের দুই নাম্বার গেটের একদম সামনেই অবস্থিত। শেখ পরিবারের জমিদারিত্বের আমলে পুকুরটি খনন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় পুকুরটিতে ওজু ও খাবার পানি নেওয়ার জন্য তালগাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো কাঁচা ঘাট ছিল।

পুকুরটির চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকশ বছরের নাম জানা-অজানা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের কবর। দীর্ঘদিন ধরে পুকুরটি মজা অবস্থায় থাকলেও ২০১৬ সালে টুঙ্গিপাড়া পৌরসভা কর্তৃক পাকা বাঁধানো ঘাটসহ চারপাশে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে পুকুরটি পার্শ্ববর্তী শেখ বাড়ির পারিবারিক জামে মসজিদের মুসল্লিদের ও দর্শনার্থীদের ওজু করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

বড় তালাব : ছোট তালাবের মতো বড় তালাবও বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরেকটি পুকুরের নাম। বড় তালাব বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অদূরে পূর্ব-দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। বিশাল এ পুকুরটি নিয়ে স্থানীয় লোকমুখে শত শত বছর ধরে রয়েছে নানা লোককাহিনি। মুঘল আমলে এখানে শেখ পরিবারের টুঙ্গিপাড়ায় বসতি স্থাপনকাল পুকুরটি খনন করা হয়। পুকুরটির সৌন্দর্যের সমৃদ্ধি এখনো মুঘল আমলে শেখ পরিবারের জমিদারিত্বের স্মৃতি বহন করে। স্বচ্ছ পানির ঢেউ আর পুকুর সব সময় যেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিমাখা দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বর্তমানে এ পুকুরটি বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে। এর চারপাশের বসার পাকা বেঞ্চগুলোয় দিনেরবেলা সারাক্ষণ লেগে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। সুবিশাল গাছের ছায়ার সমারোহে আর মনভুলানো বাতাস সহজেই কল্পনায় বঙ্গবন্ধুর বাল্যকালে নিয়ে যায়।

খান সাহেবের পুকুর : খান সাহেবের পুকুর নামটি বঙ্গবন্ধুর ছোট দাদার একমাত্র ছেলে খান সাহেব শেখ মোশাররফের নামকরণে হয়। খান সাহেবের পুকুর জীবিত বঙ্গবন্ধুর থেকে শহিদ বঙ্গবন্ধুকে বেশি মনে করিয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালে ঘাতকদের বুলেটের নির্মম আঘাতে জাতির পিতা শাহাদতবরণ করার পর টুঙ্গিপাড়া নিয়ে আসার পর এ পুকুরের পানি দিয়ে শেষ গোসল দেওয়া হয়। সে সময় শেখ বাড়ির মুরব্বি শেখ আব্দুল মান্নান বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য হিসাবে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে স্বাক্ষর সাপেক্ষে লাশ গ্রহণ করেন। পরে শেখবাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মৌলভি শেখ আব্দুল হালিমের অনেক অনুরোধের পর সেই সেনাবাহিনীর সদস্যরা গোসলের অনুমতি দেয়। তখন গিমাডাঙ্গা গ্রামের লুৎফর শেখ বালতি ভরে ভরে বঙ্গবন্ধুর গোসলের জন্য পানি নিয়ে আসেন। সে সময় প্রতিবেশী মন্নাফ মিয়া, ইদ্রিস কাজীসহ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুকে এ পুকুরের পানি দিয়ে গোসল দেন। সে সময় ব্রিটিশ আমলে শানবাঁধানো ঘাট থাকলেও বর্তমানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। পুকুরটির পাড়েই বঙ্গবন্ধুর ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ ও তার পুত্র খান সাহেব শেখ মোশাররফ হোসেনের সমাধি রয়েছে। চারপাশের সবুজ গাছপালা আর স্থির থাকা স্বচ্ছ পানি এখনো বঙ্গবন্ধু বিয়োগের ব্যথা দর্শকদের মনে পুনর্জাগরণ ঘটায়।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম