|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমরা যাচ্ছি শতবর্ষী পূজা দেখতে সিলেটের কুলাউড়াতে। আমাদের চার চাকার পাইলট পলাশ ভাই মহাসড়ক পেরিয়ে এগিয়ে চলছেন। সূর্যদেবের আভা সড়কজুড়ে পড়েছে তীর্যকভাবে। মহাসড়ক পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। ভালোই যাচ্ছিলাম আমরা, তবে মহাসড়কের করুণ দশা আমাদের যাত্রাপথের ক্লান্তি বাড়িয়ে দিল। এরপরও সবার মনের ভেতর নতুন কিছু দেখার প্রেরণা। তবে সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সবচেয়ে বড় বাধা হলো রাস্তা। এত ভাঙাচোরা রাস্তা যে ভিনদেশি পর্যটক একবার কোথাও গেলে দ্বিতীয়বার সেখানে যেতে কাউকে বলবে না। আমরা চলছি অচেনা পথ আমাদের বরণ করে নিচ্ছে। এদিকে আমাদের ভ্রমণসঙ্গী বলাই মামা বলে উঠলেন সেই সকাল থেকে পেটে তো কিছু পড়ে নাই, পেটে তো কিছু দিতে হয়। বলাই মামার কথায় সবাই সায় দিল। যে বলা সেই কাজ মহাসড়ক পাশে একটি মিষ্টির ঘরের সামনে এসে আমরা উপস্থিত হলাম। দেখতে পেলাম সবেমাত্র মিষ্টি রসের কড়াই থেকে নামিয়ে পরিবেশনার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া চলছে। সবার জিভে পানি আসার জোগাড়। আমাদের তেল ছাড়া পরোটা, মিষ্টি, বুন্দিয়া, জিলাপি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। অল্প কিছু সময়ের মাঝেই আমাদের সামনে খাবার এসে উপস্থিত। অসাধারণ স্বাদ, খাঁটি বলে কথা। পেট পূজা শেষ করে আমরা আবার আমাদের গন্তব্য পথে যাত্রা শুরু করলাম। মহাসড়ক পেরিয়ে আমরা গ্রামের পথে ধাবিত হলাম। গ্রামীণ পথ অসাধারণ তার রূপ। আমাদের পাইলট মহোদয় গাড়ি থেকে বললেন ওই দেখেন দাদা মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে। আমরা সবাই গাড়ি থেকে দেখার চেষ্টা করলাম। দূর থেকে অসাধারণ লাগছিল। গাড়ি থেকে নেমে ঘড়ির কাঁটাতে তখন বারোটা বাজি বাজি। মন্দিরের সামনে ছোটখাটো মেলা বসেছে। সেখানে সব ধরনের মানুষের ভিড় দেখতে পেলাম। চারদিকে ঢাকঢোলের বাজনা সঙ্গে শঙ্খ ধ্বনি। পথে পুণ্য লাভের আশায় মানুষের দেবী পিঠ দর্শনের জন্য ভিড়। ভিড় ঠেলেই আমরা মন্দিরের দিকে এগিয়ে চললাম। যত মন্দিরের কাছে পৌঁছাতে লাগলাম ধূপ-ধুনোর গন্ধ মনকে ভরিয়ে তুলল। প্রথমে দেখা পেলাম ভৈরবের থলির। সেখানে অনেক ভিড় ঠেলে দেবতা দর্শন করলাম, এরপর আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। পথে দেখা পেলাম ওই এলাকার রোহিত দাসের। জানতে চাইলাম মন্দিরের কথা। তিনি বললেন, পূজার্চনা আর দেব-দেবীদের আরাধনায় দেড়শ বছরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় আসীন করে নিয়েছে কুলাউড়ার কাদিপুরে শিববাড়ি মন্দিরটি। নয়নাভিরাম নানা কারুকার্যময় শৈল্পিক আঁচড় আর চারপাশের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন কাড়ে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে হিন্দু ধর্মের লোকজন দুর্গাপূজা এলেই ওখানে আসেন। দুর্গাপূজা ছাড়াও বছরজুড়ে ভক্তদের মানত আর ওখানে আসা-যাওয়ার দৃশ্য লক্ষণীয়। নবমীর দিন সকাল থেকেই পুরো দিন দেবীর তুষ্টির জন্য প্রাপ্ত উপঢৌকন হিসাবে ভক্তদের কাছ থেকে আসা পশু পাখি (কবুতর, হাঁস, পাঁঠা ও মহিষ) মন্দির সেবায়েতদের সংগ্রহের দৃশ্য নতুন আগন্তুকদের অভিভূত করে। দূরদূরান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা ভোগ নৈবদ্য, ফুল ও বিল্বপত্র নিয়ে এখানে পূজার্চনা করতে আসেন। আমরা এগিয়ে চলছি রোহিত দাসের সঙ্গে কথা বলে বলে। অসাধারণ নির্মাণশৈলী, মন্দিরের গায়ে রঙের প্রলেপ পড়েছে তাই আরও সুন্দর দেখতে লাগছিল। রোহিত দাস আরও বললেন, এ বংশের কোনো এক বংশধর তাদের দীঘির পাড়ে বেল গাছের নিচে বসে নিয়মিত শিবের সাধনা করতেন। কিন্তু তখন কোনো শিবলিঙ্গ এ বাড়িতে ছিল না। পরে পুলক সোমের তপস্যার ফসল হিসাবে ১৪০৮ সালে শিবলিঙ্গটি পাওয়া যায়। লিঙ্গটি পাওয়ার পর উপযুক্ত স্থান না থাকায় পুরোনো মন্দিরটি সংস্কার করে ওই মন্দিরেই শিবলিঙ্গটি স্থাপন করা হয়। শিবলিঙ্গটি পাওয়ার গল্প ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন থেকেই আজ পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ ভক্তরা ওখানে শিবলিঙ্গটি দর্শন করতে আসেন। শিলাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিদিনই মন্দিরে চলতে থাকে পূজার্চনা, ভোগ, আলতি, আরতি। ফুল, ফল, বিল্বপত্র, ভোগ, নৈবদ্য, ধূপ, দীপ ইত্যাদির মাধ্যমে নিয়মিত চলে দেব-দেবীর আরাধনা। জানা যায়, বড়বাড়ির (শিববাড়ির) লোকেরা ছিলেন জমিদার পরিবারের। তাদের এক সময় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদারি থাকলেও জমিদারি শাসন উচ্ছেদের পর তাদেরও অন্য জমিদার পরিবারের মতো পড়তে হয় চরম আর্থিক দৈন্যতায়। ফলে আগেও বনেদি পূজার্চনার আকাশছোঁয়া জৌলুস হ্রাস পেতে থাকে। তবে এর প্রভাবে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে মোটেই ঘাটতি পড়েনি। ধর্মীয় বিধিবিধান লঙ্ঘন না করেই পূজা-পার্বণ অব্যাহত ছিল। গত এক দশক থেকে মন্দিরটি আগের জৌলুসে ফিরে এসেছে। আমরা মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেবতা দর্শন শেষে বের হব তখন অনুষ্ঠানস্থল থেকে ঘোষণা করা হলো প্রসাদ গ্রহণ করার জন্য। কী করব আমরা সবাই ভাবছিলাম, দেখলাম সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে প্রসাদ নেওয়ার জন্য। মামা বলল চল নতুন এক জায়গার খাবার খেতে আপত্তি কিসের। আরও দীর্ঘ যাত্রাপথে কারোরই ভারী কিছু পেটে পড়ে নাই। আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। গরম গরম ভুনা খিচুড়ি পরিবেশন করা হলো আমাদের মাঝে, অসাধারণ স্বাদ। ভোজন পর্ব শেষ করার পর আমাদের যাওয়ার পালা। সূর্যদেবও নিদ্রায় যাবেন। এদিকে রোহিত দাস বললেন, এত কষ্ট করে এসেছেন তো আর কিছু সময় থেকে সন্ধ্যা আরতি দেখে যান মন ভালো লাগবে। আমারা আর না বললাম না। রাতের অন্ধকারে অন্য এক রূপের দেখা পেলাম কাদিপুর শিববাড়ির। আলো-আঁধারের ভেতরে এক অন্য রূপ ফুটে উঠেছে। সন্ধ্যা আরতি শেষে আমরা ফিরে চললাম শহর পানে।
যাবেন কীভাবে : ঢাকা থেকে সিলেটগামী বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে নামতে হবে কুলাউরা শহরে। অথবা সিলেট শহর থেকে সরাসরি যেতে পারবেন কুলাউড়াতে। সেখান থেকে সিএনজি/রিকশাযোগে শিববাড়ি যাওয়া যায়। ভাড়ার হার ১৫-২০ টাকা (জনপ্রতি সিএনজিযোগে)।
