ভরা জোছনায় নারকেল জিঞ্জিরায়
মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যখন তখন মাথায় ভ্রমণ নেশা চাড়া দিয়ে ওঠে। না যাওয়া অবধি মন থাকে পুরাই উতলা। হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়েই ছুটলাম সেন্টমার্টিন। লম্বা ছুটি থাকায় ইনানী-সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের টিকিট নেই। তাতে কী! টেকনাফ থেকে ট্রলারে চেপে যাব। পৌঁছতে পৌঁছতে ততক্ষণে ভাটা হয়ে যাওয়ায় শেষ ট্রলারটাও মিস করছি। ট্রলার নেই তো কী হয়েছে। স্পিডবোটে যাব। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া পর্যটক যাওয়ার অনুমতি নেই। কী মসিবত। ঘাটে কিছুক্ষণ দহরম-মহরম হওয়ার পর আমজাদ রফিকুল ইসলামের কারিশমায় স্পিডবোটে চড়তে সক্ষম হই।
প্রায় ঘণ্টাখানেক বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি পাড়ি দিয়ে সেন্টমার্টিন জেটি ঘাটে প্রায় বিশ বছরের মাথায় এসে পা ফেলি। শেষবার এসেছিলাম ২০০৪ সালে। পা ফেলতেই কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। ভেতর থেকে তখনো আতঙ্ক কাটেনি। যদি জেটি ঘাটের কোস্টগার্ড ফেরত পাঠিয়ে দেন। বেশ একটা ভাব নিয়ে তাদের চৌকি পার হলাম। রাতে থাকব হলা বনিয়া। তাই শুরুতেই মাছসহ প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই সেরে নিলাম। এবার বাইকে করে ছুটলাম দক্ষিণপাড়া। পৌঁছেই আগেভাগে ঠিক করে রাখা পূর্ব সৈকতের কেয়া বন লাগোয়া সুবিধাজনক এক স্থানে তাঁবু টানিয়ে ফেলি। স্থানীয় জনৈক ভদ্রলোকের বউ পারভীনকে রান্নার দায়িত্ব দিয়ে চলে যাই তরমুজ খেতে। ঢাকা শহরে থাইকা খাইত আর কম না। কিন্তু সরাসরি খেত থেকে তুলে খাওয়ার মজাই আলাদা। যা শিক্ষণীয় ভ্রমণের জন্য বাড়তি পাওনা। মাগরিবের আজান হতেই নামাজ আদায়ের প্রস্তুতি নিই। নামাজ শেষে চোখ যায় আকাশে। ইয়া বড় ডাউস সাইজের পূর্ণিমার চাঁদ। এ রকম মায়াবি চাঁদ দেখে আনমনেই বিড়বিড় করে বলতে ইচ্ছা করবে, আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। আহ নষ্টালজিয়ায় হারিয়ে যাই। সময়ের স্রোতে রাত বাড়ে। জোছনার আলো সাগরের বুকে উথলাইয়া পড়ে। রাতেও চারদিক ফর্সা। দক্ষিণপাড়ার সৈকতের বালিয়াড়িতে জোছনার আলোয় হেঁটে বেড়াই। মজার ব্যাপার হলো, এ দক্ষিণপাড়াটাই প্রথম বঙ্গোপসাগরের বুক ফুটা করে বর্তমান সেন্টমার্টিনের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল। আর আজ সে স্থানেই তাঁবু গেড়ে আড্ডা জমিয়েছি। নানা খোশগল্প চলাকালীন অন্দর মহল থেকে ডাক আসে। আমরা বলি খাবার ঢেকে রেখে দাও। আজ না হয় ঠান্ডাই খাব। পূর্ণিমার আলো উপভোগ শেষে খাবার খেতে যাই। বুদ্ধি করে খাবার হটপটে রেখে দেওয়ায় উড়ুক্কু মাছের টেস্ট ছিল লা জবাব। খেয়ে-দেয়ে চেটেপুটে তাঁবুতে ফিরি। সকাল সকাল ছেঁড়া দ্বীপ যাব, তাই চটজলদি শুয়ে পড়ি। প্রকৃতির চাপে ঘুম ভাঙে রাত চারটার কিছু আগে-পরে। তাঁবুর জিপার খুলে মাথা বের করতেই আবিষ্কার করি ভিন্ন এক জগৎ। পূর্ণিমার আলো এতটাই প্রখর ছিল যে, সাগরে নোঙর করা দূরের ট্রলারগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আহ কি যে সুন্দর লাগছিল। লিখে বোঝানো দায়। কোলাহলমুক্ত বিচে রাত গভীরে একাকী চাঁদের কিরণে, জোছনার আলোর সঙ্গে জুটি বেঁধে এক দারুণ সময় পার করে তাঁবুতে ঢুকি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার আগেই ফজরের আজানের ধ্বনি। নামাজ পড়েই হেঁটে ছেঁড়া দ্বীপের দিকে এগোই। কেয়া বনের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকি। সাগর থেকে ভেসে আসা বিশুদ্ধ হাওয়ায় শরীর মন জুড়ায়। সেন্টমার্টিনের অন্যতম আকর্ষণ সাগরের নীলাভ রঙা পানি। যা দেশের অন্য কোনো বিচ থেকে তেমন দেখা মিলে না। বালিয়াড়ীতে হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুধা পেলে, বিচে থাকা এক ছালাদিয়া [অস্থায়ী] রেস্টুরেন্টে গরম গরম খিচুড়ি দিয়ে নাশতা সেরে নিই। এরপর আবারও ছুটে চলা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবার চোখে পড়ে মোটরবাইক ও অটোয় চড়ে বানের জলের মতো ধেয়ে আসা পর্যটকদের ঢেউ। ততক্ষণে আমরা ছেঁড়া দ্বীপে ঢুকে যাই। ও মোর খোদা। এখানে তো দেখছি রীতিমতো বাজার মিলে গেছে। বিক্রেতারা নানা খাদ্যপণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আহ বিশ বছর আগে-পরের ছেঁড়া দ্বীপের চিত্র এখন পুরাই আকাশ-পাতাল। যেতে যেতে দক্ষিণের শেষ প্রান্তে। যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম তার পর আর কোনো মাটি নেই। শুধু পানি আর পানি। উত্তাল সাগরের নোনা জলে আছড়ে পড়া ঢেউ শরীর ভিজিয়ে দেয়। তখন গলা ছেড়ে আকাশ পানে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছা করবে, জীবনের মানে শুধু জীবিকার জন্য রাতদিন ব্যস্ত থাকা নয়। জীবনের মানে হলো হুটহাট প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছুটে চলা। নিজের জন্য সময় দেওয়া। বুক ভরা নিশ্বাস নিয়ে জীবনকে উপভোগ করার নামই হলো প্রশান্তির যাপিত জীবন। দেশে থাকা বেশ কিছু দ্বীপের মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপটিরও রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। গোড়ার দিকে এর নাম ছিল নারকেল জিঞ্জিরা। পরে ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯৩ সালে এর নাম রাখেন সেন্টমার্টিন। আমেরিন্ডিয়ানরা শুরুর দিকে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা ছিল। পরে ইউরোপীয়ানরা ব্যবসা করতে এসে তাদেরই নিজেদের দাসে পরিণত করে নেয়। ব্যাপারটা আজকের প্রজন্ম অনেকেই হয়তো জানে না। সেন্টমার্টিন দ্বীপটি নিয়ে এক ফরাসি, ডাচ ও স্পেন দ্বারা দখল-পালটা দখলের খেলাও চলত। দ্বীপটির বয়স প্রায় ৩৫০৫ বছর। এরও আগে প্রায় ৫০০০ বছর আগে এটি টেকনাফের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ছিল। পরে সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দ্বীপটির আরও অনেক ইতিহাস রয়েছে। যা ভ্রমণগল্পের লিখনীতে তুলে ধরা সম্ভব নয়। সেন্টমার্টিনে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ নারকেল গাছ রয়েছে। যা দ্বীপটিকে করেছে আরও বেশি দৃষ্টিনন্দন। রোদের প্রখরতা চেতিয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ছেঁড়া দ্বীপ থেকে সটকে পড়তে শুরু করি। ছেঁড়া দ্বীপ নামকরণের রহস্য না জানালেই নয়। জোয়ারের সময় সেন্টমার্টিনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলেই এর নাম ছেঁড়া দ্বীপ। ফিরছিও হেঁটে। তবে এবার পশ্চিম পাশ দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে হলা বুনিয়া তাঁবুর ধারে। গাছ থেকে ডাব নামাই। টাটকা তরমুজ খাই আর হ্যামোকে দুলে তপ্তদুপুর পার করে বিকালবেলা বিচ দিয়ে হেঁটেই উত্তরপাড়া যাই। দক্ষিণপাড়া জেগে উঠারও প্রায় একশ বছর পর উত্তরপাড়া জেগে উঠেছিল। এ পাশটায় এসে মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল প্রচুর মৃত কচ্ছপ দেখতে পেয়ে। এর কারণ খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায়, দ্বীপটিতে কুকুর বেড়ে যাওয়ায় কচ্ছপের ওপর আক্রমণের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছে। বিচে সাইক্লিং ও বাজার ঘুরে বোল কোড়াল মাছ কিনে, ভ্যানে চড়ে অস্থায়ী নিবাসে ছুটলাম। পথে দেখা হলো জালাল ভাই, জিয়া ভাই ও বাতেন ভাইয়ের সঙ্গে। রাজধানী ছেড়ে দূরে বহু দূরে তারা এখানে আছেন পর্যটকদের সেবক হিসাবে। খানিকটা সময় তাদের সঙ্গে চলল কফি আড্ডা। তাঁবুতে ফিরে শুরু হলো ক্যাম্প ফায়ার ও বারবিকিউ। ডিনার শেষে ঘুমের প্রস্তুতি। এক ঘুমেই সুবহে সাদিক। দ্রুত সাফ-সুতর হয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বিচ লাগোয়া পুচ কাটা বনিয়া গ্রামের এক মসজিদে জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করেই দক্ষিণে হাঁটা শুরু করি। হাঁটি আর প্রকৃতির আপন রঙ্গলীলার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি। চরম গরমেও হুট করেই মাঘের কুয়াশায় ঢেকে যায় চারপাশ। কুয়াশার চাদর ভেদ করেই হেঁটে হেঁটে প্রবালের প্রান্তরে। ভাটা থাকায় যতদূর চোখ যায় শুধু প্রবাল আর প্রবাল। ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এদের প্রাণ থাকলেও সাগরতলে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় কোনো দৃঢ় তলের ওপর গেড়ে বসে বাকি জীবন পার করে দেওয়া নিশ্চল হয়েই। পর্যটকদের বেশ কিছু পছন্দের তালিকায় প্রবাল অন্যতম। যা সেন্টমার্টিন ভ্রমণে দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করে। লক্ষ কোটি প্রবালের সারি সারি পাথুরে আকৃতির স্তূপ দেখার মধ্য দিয়ে সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ইতি টানি।
যাবেন কীভাবে-দেশের যে কোনো স্থান থেকে বাস/ট্রেনে প্রথমে কক্সবাজার/টেকনাফ। সেখান থেকে ট্রলার, স্পিডবোট কিংবা জাহাজে সেন্টমার্টিন। চট্টগ্রাম থেকেও বিলাসবহুল একটি জাহাজ ছেড়ে যায়। থাকাখাওয়া-প্রচুর হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। ভাড়া যার যেমন সাধ্য অনুযায়ী মিলাতে পারবেন। খাবার হোটেলও রয়েছে অনেক।
নারকেল জিঞ্জিরা ভ্রমণের উপযুক্ত সময় কখন-পুরো পরিবার নিয়ে হলে শীত কিংবা শরতে। আর অ্যাডভেঞ্জার প্রিয়দের জন্য গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষায়। তবে যখনই যাবেন পূর্ণিমা সামনে রেখে গেলে সেন্টমার্টিনের আসল সৌন্দর্য চোখে ধরা দেবে। সেই সঙ্গে দ্বীপটি ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য, যানবাহনের চেয়ে হাঁটলেই বেশি ভালো লাগবে।
ছবি : নাজমুল আহমেদ
