Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

প্রকৃতি

রিমঝিম বৃষ্টির ফুল

Icon

শেখ আব্দুর রহিম

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।/কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত ‘সোনার তরী’ কবিতায় বর্ষাকালের বৃষ্টির উপর ভরসা না রাখলেও এসময়ের প্রকৃতির নৈসর্গিক অপরূপ স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে কিন্তু ভরসা হারানো দায়। কখনো হালকা আবার কখনোবা মুষলধারে এক পশলা বৃষ্টি এসে পুরো প্রকৃতিকে প্রাণের সঞ্চারে একাকার করে দেয়। বর্ষার আগমনের বার্তায় বাংলার আবহমানকালের প্রকৃতি সাজে কদম, বেলি, পর্তুলিকা, নাগচম্পা, কাঠ মালতিসহ রংবেরঙের কতশত ফুলে। আজকের আয়োজনে থাকছে সেসব বাহারি ফুলের মনমাতানো সৌন্দর্যের কথা।

বাদল দিনের কদম ফুল : ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল/বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’-প্রেমের কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় প্রেম নিবেদনের মাধ্যম হিসেবে কদমের সুনিপুণ বন্দনা করতে একদমই ভোলেননি। বর্ষার ঝরঝর ধারা আর কদমের সংমিশ্রণ সত্যিই প্রেমিক মনে ভালোবাসার কবিতার পঙ্ক্তির রেখাপাত করে। বর্ষায় কদম ফুল প্রেমের প্রতীক। এ সময়ে রিমঝিম বৃষ্টির মাঝেই সবুজ পাতার ফাঁকে হলুদ কদম ফুলের লুকোচুরি বর্ষার আগাম বার্তা দিতে থাকে। হলুদ বলের মতো গোল, মাংসল পুষ্পাধারে অজস্র সরু সরু হলুদ ফুলের বিকীর্ণ বিন্যাস, মঞ্জরির রং সাদা-হলুদে মেশানো প্রতিটি ফুল সৌন্দর্যের আলোকচ্ছটা হয়ে ধরা দেয়। ফুল ফোটার প্রথমে সবুজ রং ধারণ করলেও ক্রমশ হলুদ রঙে রূপান্তরিত হয়ে পরিপূর্ণ ফুলে রূপান্তরিত হয়। পাকা ফুল অনেকটা গাঢ় কমলা রং ধারণ করে কমলা সাদৃশ্য হয়। পাকা কদম খাবার হিসাবে বাদুড়সহ অন্য পাখিদের বেশ পছন্দ। কদমের গাছের বাকলের রস পেটের কৃমি দূরীকরণ ও জ্বরের ওষুধ হিসাবেও বেশ উপকারী।

মোহনীয় সুবাসে বেলি ফুল : বৃষ্টিতে ভেজা মাটির গন্ধের সঙ্গে বেলির মোহনীয় সুবাস যে কারোরই মন সতেজ করে দেওয়ার উপকরণ। সবুজ পাতার ঘোমটা সরিয়ে শুভ্র পাপড়ির বেলি যেন স্বর্গীয় নির্মলতার ছোঁয়া এনে দেয়। এর স্নিগ্ধ সৌরভ এবং শুভ্রতা বৃষ্টির দিনে মনোরম অনুভূতি এনে দেয়। বেলি ফুলের খ্যাতি কেবল তার সৌন্দর্যের জন্যই নয়, বরং তার ব্যবহারিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও প্রচুর। বেলি ফুল বিভিন্ন সংস্কৃতিতে পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসাবে গণ্য হয়। বাঙালি বিয়েতে বেলি ফুলের মালা বর-কনের সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানেও এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। বেলি ফুলের সুগন্ধ মানসিক চাপ কমাতে এবং মেজাজ উন্নত করতে সাহায্য করে। এর তেল ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং শুষ্কতা দূর করতে বেশ সহায়তা করে। এছাড়া ছোট সাদা এ ফুলটির নির্যাসে জীবাণুনাশক গুণ আছে যা সংক্রমণ রোধে সাহায্য করে।

সৌন্দর্যের লুকোচুরির পর্তুলিকা ফুল : সূর্য উদয় থেকে ফোটা আর অস্তমিত থেকে বুজে যাওয়া এক ফুল পর্তুলিকা। তার এ সময়ানুবর্তিতার ওপর ভিত্তি করে অনেকে একে টাইম ফুলও বলে থাকে। বর্ষাকালের শুরু থেকে শেষ অবধি চলতে থাকে তার সৌন্দর্যের লুকোচুরি। লাল, নীল, গোলাপি, হলুদ, কমলা সাদা ও দ্বৈত রঙের পর্তুলিকা সাধারণত চোখে পড়ে। প্রতিকূল পরিবেশে ও কম পরিচর্যায় এ গাছ টিকে থাকে। বর্তমানে বাসাবাড়ির বেলকনি, ছাদে ও রেস্তোরাঁয় এ ফুলগাছ বেশ জনপ্রিয়। তীব্র সূর্যালোক সহ্য করার ক্ষমতা এবং মাটিতে ছড়িয়ে পড়ার স্বাভাবিক প্রবণতার কারণে এটি একটি আদর্শ গ্রাউন্ড কভার হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর চাষের সহজলভ্যতা এবং খরারোধী গুণাবলি একে বিশ্বব্যাপী বাগানপ্রেমীদের কাছে প্রিয় করে তুলেছে।

সাদা সৌরভময়ী নাগচম্পা : নিচে চিকন ওপরে সুচালো গোল সাপের ফণীর মতো পাতার গাছ নাগচম্পা বা নাগেশ্বর। বর্ষাকাল শুরু হওয়ার আগে থেকেই গাছটিতে ফুল আসতে শুরু করে। সাদা সৌরভময়ী ৪-৫টি সাদা পাপড়ি ও হলুদ কেশরের হালকা সুবাসযুক্ত ফুল নাগচম্পা। বৃষ্টিতে এ গাছের ফুলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর অকৃত্রিম সৌন্দর্য আর মোহনীয় সুবাস ছড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে ফুল ফোটা ও টিকে থাকার কারণে অনেকেই বসতবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে বেশ আগ্রহ নিয়ে গাছটি লাগান। দ্রুত বর্ধনশীল এ ফুলের গাছ লাগানোর কয়েকবছর পর বেশ উঁচুতে চলে যায়। নাগচম্পার সৌন্দর্যময় ফুল বাগানের সৌন্দর্য বাড়ায় এবং ফুলের সুগন্ধ চারপাশের পরিবেশকে সুরভিত করে তোলে। এর সুগন্ধি ধূপ ও সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। নাগচম্পার ফুল, পাতা ও ছাল থেকে আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি হয়। এটি প্রদাহনাশক, ব্যথানাশক ও জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

জংলি টগর কিংবা কাঠ মালতি : কাঠ মালতি বা কাঠ মল্লিকাকে অনেকে জংলি টগর বলে থাকে। সাদা ক্ষুদ্রাকায় ফুলের মধ্যে সৌন্দর্যে অন্যতম সেরা ফুল এটি। ঝোপালো ছোট ছোট পাতা আর ঘন ডালপালার মাঝে বর্ষার শুরু থেকে এ ফুল ফুটতে শুরু করে। সুগন্ধিযুক্ত এ ফুলের পাপড়ির সংখ্যা ৫টি এবং একসঙ্গে মোড়ানো থাকে। ফুল শেষে গাছটিতে ছোট ফল দেখা যায়, যা পরে বীজে পরিণত হয়। বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মে।

কাঠ মালতি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। এটি সূর্যের আলোতে দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তবে আংশিক ছায়াও সহ্য করতে পারে। এটি সাধারণত বাগানে ও বাড়ির আশপাশে শোভা বৃদ্ধির জন্য লাগানো হয়। কাঠ মালতির মূল ও শেকড়ে কৃমি ও চুলকানি দূর করতে ব্যবহৃত হয়।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম