|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তার প্রিয় সোনার বাংলা, স্রষ্টা আর সৃষ্টির অনাবিল চেতনার এক বৈচিত্র্যময় রূপকল্প। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সাহিত্যকর্মের উৎস ও প্রেরণাস্থল এ সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ। এ দেশের তৃণমূল মানুষ, নদী ও নদীতীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার চিন্তা ও মননে যে নান্দনিক ভাব ও ভাষাশিল্প সৃষ্টি করেছিল, সেটাই আজ বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতির গৌরবময় অর্জন। বাংলাদেশের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে, নিসর্গে রবীন্দ্রনাথ তাই মিশে আছেন অকৃত্রিম আত্মিক বন্ধনে। শিল্প-সাহিত্য-সমাজ, কৃষি-রাজনীতি-জীবনাচার, আনন্দ-বিষাদ, পূর্ণতা-অপ্রাপ্তি, সমস্যা ও সম্ভাবনা-সর্বত্রই যেন আছে তার চিন্তার সরল বিচরণ। সমকালে যেমন উত্তরকালেও তাই তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। মানুষের জন্য, সুন্দরভাবে জীবনযাপনের শিল্পকলা আয়ত্ব ও চর্চা করার জন্য তার অনুভূতি এবং ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য বিরাট প্রেরণার উৎসভূমি। রবীন্দ্র-দর্শন যে জীবনবোধের কত বড় খনি, তা যিনি রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করতে পেরেছেন, তিনিই বুঝেছেন। বাঙালি ঘরে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়, সেভাবেই তাকে চেনানো হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। কলকাতার জোড়াসাঁকোয় ১৮৬১ সালের ৭ মে কবি জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের সারদা দেবীকে। ১৮৮৩ সালে কবির মামাবাড়ির দিঘির অপর পাড়ের বেণীমাধব রায় চৌধুরীর কন্যা মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এভাবে আত্মীয়তার নিগূঢ় বন্ধনে কবি আবদ্ধ ছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে। কবিগুরুর প্রথম জন্মদিন পালন করা হয়েছিল কবে? রবীন্দ্রনাথের ভাগনি (বড়দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে) সরলা দেবী তার আত্মকথা ‘জীবনের ঝরাপাতা’-তে লিখছেন... রবি-মামার প্রথম জন্মদিন-উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা (সত্যেন্দ্রনাথ) ও নতুনমামার (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) সঙ্গে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) ৪৯ নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে উলটা ডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তার ঘরে তার বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল এবং একজোড়া ধুতি চাদর তার পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন। সে বছর থেকে তার জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হলো।’ সে বছরটি ছিল ১২৯৪ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ (১৮৮৭ সালের ৭ মে কবির বয়স তখন ২৫ পেরিয়ে ২৬ পদার্পণ)। রবীন্দ্রনাথ তখন ১৬-১৭ বছরের। বিলেত যাওয়ার আগে ইংরেজি ভাষা আর বিদেশি আদব-কায়দা শেখার জন্য মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথামতো বোম্বাইয়ের এক অভিজাত মারাঠি পরিবারে, বেশ কিছুদিন কবি বসবাস করেছিলেন। সে পরিবারের বিলেত ফেরত শিক্ষিতা, স্মার্ট ব্যক্তিত্বের সুন্দরী মার্জিতা বড় কন্যা আন্না তড়খড়ের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। হয়তোবা, সেটাই ছিল কবির জীবনের প্রথম অনুচ্চারিত গোপন ভালোবাসা। ভালোবেসে কবি আন্না তড়খড়ের নাম দিয়েছিলেন ‘নলিনী’। আন্না সে নামটিই লেখালিখিতে ব্যবহার করতেন আজীবন। শুধু তাই নয়, নিজের ভাইপোর নাম রেখেছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথ’। শোনা যায় কবির প্রথম প্রেমের নায়িকা ছিলেন এ আন্না। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার থেকে পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি কাজের দেখাশোনা করতে বাংলাদেশে আসেন। এ সময় শিলাইদহের কুঠিবাড়ি থেকে পদ্মা, ইছামতি, করতোয়া, বড়াল, আত্রাই, চলনবিল আর পতিসরের নাগর নদীতে কবি বোটে বসে বাংলার নদীতীরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেন, যা কবিকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল তার দুর্লভ সাহিত্য সৃষ্টিতে। বাংলার অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে তিনি অসংখ্য চিঠি লেখেন, যা তার-‘ছিন্নপত্রাবলী’তে প্রকাশিত হয়েছে। ২০ বছর বয়সে কবির প্রথম উপন্যাস ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’-এর পটভূমি রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের যশোর জেলার প্রতিপত্তিশালী জমিদার প্রতাপাদিত্যের পরিবারিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কবির অনন্য সৃষ্টি সোনার তরী, বৈতালী প্রভৃতি কবিতা ও বিসর্জন নাটক নদীমাতৃক বাংলাদেশের বহমান নদীর বুকে বসেই লেখা। বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ ও আবেগের মরমি সুর, কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি জারি, সারি গানের বৈচিত্র্যময় সম্মিলন ঘটেছে রবীন্দ্র সুর ও সংগীতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই শিশু বয়সেই মায়ের কোলে ও হাত ধরে বাংলাদেশে আসতেন বিভিন্ন পূজা-পার্বণ ও সামাজিক অনুষ্ঠানের সুবাদে। দাম্পত্য জীবনে বাংলাদেশেই কেটেছে কবির আবেগময় অনেক দুর্লভ মুহূর্ত। বিশ শতকের প্রথম থেকেই সুদূর রাজশাহী থেকে কুষ্টিয়া অবধি ছিল কবির অবাধ বিচরণ। ১৮৯৮ সালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দিতে, কবি ঢাকা এসেছিলেন। ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে খুলনার মহকুমা হাকিম আদালতে এসেছিলেন মামলার সাক্ষ্য দিতে। ১৯২৬ সালে কবি আবার ঢাকায় আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকায় তুরাগ হাউজ বোটে কবির থাকার জায়গা করা হয়। করোনেশন পার্ক, নর্থব্রুক হল, কার্জন হলে কবি Philosophy of Art, What is Art ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখেন। অবশেষে, ময়মনসিংহ ঘুরে কবি রওনা হন শান্তিনিকেতনে। কবির জীবদ্দশায় বাংলাদেশে ছিল তার শেষ পদচারণা। রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত নাটক হলো ‘বাল্মিকী প্রতিভা’(প্রকাশ ১৮৮১ সাল)। আগে এ নাটকের নাম ছিল ‘রুদ্রচণ্ড’। রবীন্দ্রনাথ ৮ বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখেন ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলি দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিই তাতে, হাপুসহুপুস শব্দ, চারিদিক নিঃস্তব্ধ, পিপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।’ প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশ হয়েছিল ‘ভারতী’ পত্রিকায় কবির বয়স তখন, ১৪ বছর। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ১৩ বছর ১০ মাস। তিনি জীবনের অভিজ্ঞতায় প্রথম মৃত্যুকে দেখেছিলেন। তার মা সারদা সুন্দরী দেবী মারা যান। মায়ের অকালমৃত্যু বালক রবীন্দ্রনাথকে বিহ্বল করে তুলেছিল। সে কথা তিনি ‘জীবন স্মৃতি’তে লিখে রেখে গেছেন চোখের জলে। কবির লেখা প্রথম নাটক ‘পৃথ্বীরাজ পরাজয়’ নাটকের পাণ্ডলিপি কবির জীবদ্দশাতেই হারিয়ে যায়। কবির স্বাক্ষরযুক্ত কবিতা প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৮৭৫ সালে, অমৃতবাজার পত্রিকায়। কবিতার নাম ‘হিন্দু মেলার উপহার’। ১৮৭৭ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম মঞ্চাভিনয় করেন, নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ‘অলীক বাবু’তে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’ প্রকাশ হয়েছিল ১৮৭৮ সালে। কবির প্রথম গদ্যগ্রন্থের নাম হলো ‘ য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’...। রবীন্দ্রনাথ প্রথম উপন্যাস লেখেন, যার নাম ছিল ‘করুণা’ কিন্তু সেটা অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই থেকে যায়। ১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গান হলো.. ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’ (এ গানটি শিখ সন্ত গুরু নানকের ভজন.. ‘গগন মে থাল, রবি চন্দ্র দীপক বনে’.. এর আক্ষরিক অনুবাদ..।) এ গানটির পরের লাইনগুলো কবির নিজস্ব মননশীলতায় লেখা। এটি ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-র ১৮৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের (১২৮১ বঙ্গাব্দের মাঘ-ফাগুন) সংখ্যাতে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এখনো নমস্য। তার ভাবনা এবং প্রত্যক্ষ কর্মসূচি বিশ্বমানবতার জন্য বিশেষ বারতা হয়ে থাকবে আরও বহুদিন। সত্যদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আমরাও আজ বলতে পারি-মানুষের জন্য পৃথিবীর সব সুখ-শান্তি ও সম্পর্ক, পৃথিবীর দৃশ্য ও কাঠামো পরিবর্তনের জন্য মানুষের বেঁচে থাকা ও মৃত্যু নয়।
