ভ্রমণ
কুয়াকাটায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত
সেলিম আল রাজ
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মনের গহিনে ঢেউ ওঠে। জলরাশির ওপর সূর্যের লুকোচুরির অপরূপ খেলা হৃদয়কে টানে প্রবলভাবে। একপলক দেখার স্বাদ জাগে ক্ষণে ক্ষণে। সংকল্প আঁটি। অন্যদের সঙ্গে ভাবনার জানান দিলাম। আগ্রহী হলো আব্দুল্লাহ আল মামুন, নজরুল ইসলাম ও মোস্তাফিজুর রহমান। সবাই সমবয়সি সহকর্মী হওয়ায় বাড়তি উদ্দীপনা ছিল আমাদের মাঝে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো আমাদের দুরন্তপনা। যাত্রার কয়েকদিন আগেই ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করে রাখি। পরিষ্কার আবহাওয়া। সকাল ১০টায় ট্রেনে চড়ে গৌরীপুর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন। স্টেশন ছেড়ে দুই পা হেঁটেই সিএনজিযোগে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল যাই। পছন্দমতো পটুয়াখালীগামী লঞ্চে বুকিংয়ের সঙ্গে সঙ্গেই হাতে কেবিনের চাবি দিয়ে দিল কর্তৃপক্ষ।
রাত আটটার দিকে উচ্চ শব্দে হুইসল বাজিয়ে যাত্রা শুরু করে আমাদের লঞ্চ। জোছনা ভরা আকাশ। অপূর্ব দৃশ্য। মাথার ওপর চাঁদের আলো। মনোলোভা পরিবেশ। শুইতে মন না চাইলেও কেবিনে চলে আসি। শিপ বয়ে চলেছে আপন গতিতে। ভোর সাড়ে চারটার দিকে পটুয়াখালী লঞ্চঘাটে ঘুম ভাঙে। ঘাট থেকে আধো আঁধারের মধ্যে অটোরিকশাযোগে বাসস্ট্যান্ড। সকাল ৬টায় লোকাল বাসে কুয়াকাটার উদ্দেশে যাত্রা করি। দুই ঘণ্টার পথ। পিচঢালা সড়ক পেরিয়ে পৌঁছি গন্তব্যে। দূর থেকে সাগরের রূপ দেখা যায়। ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে নৈসর্গিক সমুদ্রসৈকত। পর্যটক দেখেই ভাড়ায়চালিত মোটরবাইক ছুটে আসে। আমরা দুটি বাইক নিলাম। একটায় আমি আর আব্দুল্লাহ আল মামুন, অন্যটায় মোস্তাফিজুর রহমান ও নজরুল ইসলাম।
কলাপাড়া জিরো পয়েন্ট থেকে প্রথমেই যাই শুঁটকি পল্লির দিকে। সমুদ্র থেকে ধরা মাছ শুকাতে ব্যস্ত স্থানীয় লোকজন। স্তরে স্তরে টানানো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে বাইক চালকের সঙ্গে আমাদের চলে খোশগল্প। শুঁটকি পেরোতেই লেবুর বাগান বন। মিনিট পাঁচেক এগোতেই লাল কাঁকড়ার চর। অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। লাল টুকটুকে কাঁকড়ার খেলা ও লুকোচুরি। শব্দ পেলে ফুরৎ করে গর্তে লুকিয়ে পড়ে। দেখতে দারুণ লাগে।
সাগরের প্রশান্তির বাতাসে মন দুলে যায়। হালকা সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে পশ্চিম প্রান্তে মোহনায় পা রাখি। এখান থেকে নদী আর সমুদ্রের মোহনায় জেগে ওঠা ফাতরার বন দেখা যায় আংশিক। বনের ভেতর গেলে লঞ্চে যেতে হয়। যেতে-আসতে লাগবে ঘণ্টাতিনেক। মূলত ফাতরার বন ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের একটা অংশ। সে কারণে ফাতরার বনকে দ্বিতীয় সুন্দরবন বলা হয়।
পশ্চিম প্রান্ত থেকে আবারও জিরো পয়েন্টে ফিরে আসি। এবার আরেক দফা বাইক চালকের সঙ্গে চুক্তি হলো তিনটি স্পটে যাওয়া নিয়ে। সৈকতের বেলাভূমি থেকে পাকা রাস্তা হয়ে সোজা চলে গেলাম নৌকা জাদুঘরে। রাখাইন মার্কেটের পাশেই নৌকা জাদুঘরটির অবস্থান। ভেতরে একটা বিশাল পালতোলা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ রাখা। ৯০ টন ওজন, ১১ ফুট উঁচু। একটু এগোতেই কুয়াকাটা শব্দের উৎপত্তি স্থানে গেলাম। ১০-১৫ ফুট ব্যাসের একটা কুয়া। এ কুয়া থেকেই কুয়াকাটার নামকরণ। তার পাশেই শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার। দুই জায়গারই প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। কারুকার্যমণ্ডিত শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহারের অবকাঠামো। ভেতরে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ৩৬ ফুটের উচ্চতার অষ্টধাতুর বৌদ্ধ প্রতিমা।
দেখতে দেখতে দুপুর গড়াল। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। চিংড়ি মাছ দিয়ে ভূরিভোজের পালা শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। সবাই কম বয়সি হওয়ায় অ্যানার্জি ছিল শরীরে। বিকালে আবার বেরিয়ে পড়ি। জিরো পয়েন্ট থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান। বিভিন্ন ধরনের বনজ-ফলদ গাছে ভরপুর। সাগর লীলাভূমিতে ব্যস্ত পর্যটক। ঘুড়ি ওড়ানো, মোটরসাইকেল চড়া, ঘোড়ার গাড়িতে চড়া, কেউবা স্পিড বোর্ডে সাগরের বুকে ভাসে। সময় বাড়তে থাকে। কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের জন্য আমরা ব্যাকুল প্রতীক্ষায়। হাতে ক্যামেরা। একটার পর একটা ক্লিক। লাল সূর্য ডোবার অপূর্ব দৃশ্য ধরে রাখার চেষ্টা।
যতই রাত বাড়ে ততই সৈকতে অন্য রকম অনুভূতি জাগায়। একদিকে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন অন্য পাশে লোকজনের সরগরম উপস্থিতি। বিভিন্ন ধরনের দোকানপাটে লোকজনের ভিড়। টং গাড়ি কিংবা ছোট ছোট দোকানে চিংড়ি, রূপচাঁদা, কোরাল, কাঁকড়া ও সামুদ্রিক মাছে সাজানো। পছন্দমতো মাছ কিনে তাৎক্ষণিক ভাজি করে দিচ্ছে পর্যটকদের। চাইলে বারবিকিউ করে খেতে পারেন। সন্ধ্যার পর থেকেই জমে ওঠে কসমেটিক পণ্য, সামুদ্রিক শামুক-ঝিনুকের দ্রব্যাদি ও নানা স্বাদের আচার কেনাবেচা। রাত ১১টায় রেস্টুরেন্টে রাতের ভোজনপর্ব শেষ করে হোটেলে ফিরি।
আরেক কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যের অপেক্ষা নিয়েই রাতে ঘুমাতে যাই। খুব ভোরবেলায়ই ঘুম থেকে উঠি আমরা। হোটেলের সামনে আসতে না আসতেই লোকজন বাইকচালক নিয়ে ভোঁ দৌড়। ছয় কিলোমিটারের পথ। কুয়াকাটার মূল পর্যটন স্পট থেকে পূর্বদিকে গঙ্গামতির অবস্থান। সাগর আর নদীর মোহনা এটি। এখান থেকে সূর্যোদয়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য সবচেয়ে সুন্দর দেখা যায়। যার টানে ছুটে আসে হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু। স্বাদ জাগে আবারও দেখার।
যেভাবে যাবেন : নদী ও সড়কপথে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাওয়া-আসা করা যায়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সড়কপথে কম সময়ই যে কোনো জেলা থেকে বাসে কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। নদীপথে গেলে ঢাকা সদরঘাট থেকে প্রথমেই যেতে হবে পটুয়াখালী কিংবা বরিশাল লঞ্চঘাট পর্যন্ত। সেখান থেকে সরাসরি কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে বাস আনাগোনা করে।
