Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

ভ্রমণ

ঝিরি ঝরনা বন-জঙ্গলে একদিন

Icon

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চট্টগ্রাম বিভাগের মিরসরাই। মিরসরাই শব্দের আভিধানিক অর্থ আমার জানা নেই। তবে নিজের মতো করে যদি এর অর্থ দাঁড় করাই, তাহলে লিখব মিরসরাই মানে ভ্রমণপাগলুদের অভয়ারণ্য। এ উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য ঝরনা, ঝিরি, কুম, খুম। যা এখনো অনেক ভ্রমণপিপাসুদের অজানাই রয়ে গেছে। এর একপাশে খাড়া পাহাড়। আরেক পাশে উত্তাল সমুদ্র। পাহাড়ের ওপর থেকে তাকালে সাগরের হাতছানি। সাগর হতে দেখলে পাহাড়ের ইশারা। কান পাতলেই বার্কিং ডিয়ারের ডাক। ঝরনার গান। ঝিরির বুকে বয়ে যাওয়া কলকল পানির মাতাল সুর। নাম না জানা নানা বৃক্ষের ছায়াঘেরা পথে স্তূপ হয়ে থাকা পাতার মরমর আওয়াজ। কখনো বা আবার টসটসা পাকা ঢাউস সাইজের ডুমুর কিংবা জংলি ফল ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দ। সাপ, বিচ্ছু ও রক্তচোষা জোঁকের দৌরাত্ম্য। চাইবারখুম ও গৌয়াতলী ট্রেইলটাও হয়তো ওইসবের বাইরে হবে না।

দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা খোঁজ পেতেই এক মোক্ষম সময়ে ছুটে যাই মিরসরাই। রাত গভীরে সায়দাবাদ থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসে চড়ে পাখি ডাকা ভোরে গিয়ে নামি। উপজেলার আমবাড়িয়া গ্রামে পূর্বপরিচিত গাইডের বাড়িতে সকালের নাশতা সেরে, গৌয়াতলীর উদ্দেশে সিএনজিতে চেপে বসি। গাড়ি যাচ্ছে পাহাড়ি উঁচু নিচু পিচঢালা সড়কে। একপাশে পাহাড়, আরেক পাশে গভীর গিরিখাদ। কবিতা পছন্দ না করা মানুষটাও হয়তো এ রকম প্রাকৃতিক দৃশ্যের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে, নিজের অজান্তেই দু-চার লাইন কবিতা আবৃত্তি করে বসবে। অল্প সময়ের মধ্যেই গৌয়াতলী পৌঁছি।

এবার হেঁটে লেবু বনের ভেতর দিয়ে নিচের দিকে নামা। প্রথমে যাব চাইবারখুম ঝরনায়।

আগের রাতে ঝুম বৃষ্টি হওয়ায় মাটিতে পা ফেলার আগেই যেন দ্রুত এগিয়ে যায়। খেলার শুরুতেই কেউ কেউ পালটাপালটি খেয়ে জামাকাপড়ে কাদা মাখাল। তবুও মনের গহিনে আনন্দের দোল। হাজার হাজার লেবুগাছের মাঝ দিয়ে ছুটে চলা। বড় বড় কাঁটাযুক্ত গাছগুলোর তলায় শতশত লেবু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এরকম দৃশ্য দেখে ৯০ দশকের গায়ক রতন খন্দকারের সেই গান, কাঁটার আঘাত দেবে/সুবাস দেবে না ফুল/তাই কি হয়। আসলেই তাই। কাঁচাপাকা হরেক জাতের লেবুর সুঘ্রাণ ট্র্যাকিংয়ের প্রাণ বাড়াতে সাহায্য করেছে। যেতে যেতে ঝিরি পথে। মাথার ওপর আকাশছোঁয়া নাম না জানা পুরোনো সব বৃক্ষের ছায়া। চোখের সামনেই লাল টসটসে পাকা ডুমুরের সুবাস। গাইড দেরি না করে গাছ থেকে কয়েকটা পেড়ে আনল। ও-মা হাতে নিতেই দেখি এত বড় এক আনারের সাইজ। কালারটাও জবরদস্ত। চাকু দিয়ে কেটে মুখে দিতেই দেখি লাল ড্রাগনের স্বাদ। সত্যিই তখন আমরা সবাই অভিভূত। দুই যুগের ওপরে হতে চলল বন-জঙ্গলে ঘুরি, কিন্তু এ রকম সাইজ কালার ও মজার ডুমুর ফল কখনো দেখা কিংবা খাওয়া হয়নি। বেশ মজা করে ডুমুর খাওয়ার পর আবারও হাইকিং শুরু। এবার সামনের দিকে এগোতে হচ্ছে ছোট বড় পাথরের বোল্ডার মাড়িয়ে। যেতে যেতে কিছুটা জংলি পথ ছাড়িয়ে ওপর দিকে উঠতে থাকি। উঠার সময়কালটা ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। দেহটা হালকা পাতলা আছাড় পাহাড়ের পর পাহাড়ের ওপরে উঠতেই দিল ঠান্ডা। ঠান্ডা ঠান্ডা দিল ঠান্ডা। ভিন্ন রকম নয়নাভিরাম এক প্রকৃতির মাঝে চাইবারখুম ঝরনার অবস্থান, আমাদের চোখ জোড়াও ঠান্ডা করে দেয়। সবুজেঘেরা পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে ঝরনার ধবধবে সাদা পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রই। ঝরনার পানির চাপে বেশ সুন্দর জলাধার/খুম সৃষ্টি হয়েছে। সে খুমে ঝাঁপ দেওয়ার পর শরীরটাও ঠান্ডা। চাইবারখুমকে কেউ কেউ চাইবারখুমও বলে থাকে। তা যাই হোক। নামে কি আসে যায়। ভ্রমণপিপাসুরা এর সৌন্দর্যে আপ্লুত হতে পারাটাই বড় কথা। বেশ খানিকটা সময় ঝরনার পানিতে ডুবাডুবি করে ছুটলাম এবার গৌয়াতলী ট্রেইলে। যেতে যেতে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে থাকা সরু এক পথে ঢুকে গেলাম। ভ্রমণের আসল মজাটা মনে হয় এখান থেকেই শুরু। চকচকে সবুজ লতাগুল্ম দিয়ে ঘেরা পথ। দুই তিন ফুট দূরত্বেও কেউ কাউকে দেখি না। আহ কি মজা। পুরোই গা ছমছম করা পরিবেশ। নিশ্চই অচেনা কোনো সাপের দেখা মিলবে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এগোতে থাকি। যতই এগোতে থাকি ততই মুগ্ধ হতে থাকি। সরু পথ ছাড়িয়ে, ছড়ানো ছিটানো বড় বড় পাথরের চাই থাকা ঝিরিপথ মাড়িয়ে পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে থাকি। উঠতে উঠতে কানে ভেসে আসে গানের শব্দ। এই গান সেই গান নয়। এটা হলো অপার্থিব সুরের ঝরনার গান। কিছুটা এগোনোর পরই দূর থেকে চোখে ধরা দেয় গৌয়াতলী ঝরনা। কাছাকাছি পৌঁছতে খানিকটা পাহাড়ি পিচ্ছিল পথ পার হতে হবে। অদম্য দে-ছুট তা থোড়াই কেয়ার করে। বেশ সাবধানতার সঙ্গে এগোতে এগোতে একেবারে গৌয়াতলী ঝরনার পানির নিচে হাজির। আনন্দে সবাই আপ্লুত। প্রতিটা ঝরনারই আলাদা আলাদা নিজস্ব সৌন্দর্য রয়েছে। গৌয়াতলী ঝরনাটাও সে রকম। এ ঝরনার আকার আকৃতি ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা আদতে আমার পক্ষে লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। এক কথায় অসাধারণ। ঝরনায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে মৃত্যু কূপ, সামনে তাকালে ঘন বন জঙ্গল আর ওপরে তাকালে ঝকঝকে নীল আসমান। সেই আসমানে আবার সাদা মেঘের ভেলা। ঠিক এসব কারণেই ভ্রমণপাগলুরা নানা ঝরনার প্রান্তরে ছুটে যেতে ভালোবাসে। বেশ কিছুক্ষণ জলকেলি শেষে দিনের আলোয় ফেরার পথ ধরি।

যাতায়াত ঢাকা-চিটাগাং রুটের যে কোনো পরিবহণে চড়ে মিরসরাই। সেখান থেকে সিএনজি করে আমবাড়িয়া বাজার। বাজারের দোকানিদের সঙ্গে আলাপ করে স্থানীয় গাইড নিয়ে গৌয়াতলী।

থাকা-খাওয়া শুকনো খাবারদাবার সঙ্গে রাখতে হবে। থাকার দরকার নেই। দিনে দিনেই ঘুরে আসা যাবে।

ছবি : ‘দে-ছুট’ ভ্রমণ সংঘ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম