কক্সবাজারে মাছের রাজ্যে...
সুমন্ত গুপ্ত
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত ঈদের বন্ধের আগের দিনটা। অফিসে কাজের চাপও বেশি। তারপরও দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। কারণ অফিস থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হতে পারব তত তাড়াতাড়ি গন্তব্যে যাত্রা শুরু করতে পারব। এদিকে তপন দা’কে আগের থেকে বলে রেখেছিলাম কাজ শেষ করেই বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু বিধিবাম, হাতের কাজই শেষ হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রাত সাতটার দিকে অফিস থেকে বের হলাম। বাসায় এসেই দ্রুত তৈরি হয়ে সিলেট থেকে যাত্রা করলাম গন্তব্যে। ছুটে চলা জীবনধারার মতো আমরাও ছুটে চললাম। রাতের আঁধার ভেদ করে ছুটে চলছি তবে মহাসড়কে বাসগুলোর গতির যুদ্ধ দেখে ভয়ই লাগছিল। আমার পাইলট মহোদয় গতির যুদ্ধে না গিয়ে ধীর গতিতেই চলছিলেন। তাজপুর, শেরপুর, হবিগঞ্জ পেরিয়ে এগিয়ে চলছি আমরা। ও, বলাই হল না, আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমরা যাচ্ছি বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের দিকে। আমার আরেক ভ্রমণসঙ্গী সানন্দা গুপ্তকে ঢাকা থেকে নিতে হবে। তাই প্রথমে আমরা ঢাকার পাথেই ছুটে চললাম। ভৈরবে হোটেল রাজমণিতে খানিক বিরতি দিয়ে ছুটে চললাম আমরা।
ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ২টা বাজে। ঢাকা শহরের বুকে নাগরিক জট। তবে এত রাতে নাগরিক জট থাকার কারণও আছে। আর একদিন পরই পবিত্র ঈদুল আজাহা।
অবশেষে সানন্দা গুপ্তকে নিয়ে ছুটে চললাম কক্সবাজারের দিকে। বেলা ১১টার দিকে আমরা চট্টগ্রাম শহরে পা দিলাম। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার ছুটে চললাম। কিন্তু পথ আর শেষই হতে চাইছিল না। শেষ পর্যন্ত বিকাল তিনটার দিকে আমরা পা ফেললাম আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নেমেই ছুটে যেতে চাইছিলাম সমুদ্র সৈকত। কিন্তু আকাশের মন ভালো নেই। আঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে সমুদ্রে চলছে ৪ নাম্বার সতর্ক সংকেত। আমার সহধর্মিণী কোনোভাবেই এসময় সৈকতে যেতে দেবেন না। তাই দূর থেকে সমুদ্র দেখে মন ভরাতে হল। আমার মন খারাপ দেখে সানন্দাই কোথায় যাওয়া যায় তার খোঁজ নিতে লাগলেন। বললেন, কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আমরা কিন্তু বের। আমি বললাম ঠিক আছে কিন্তু কোথায় যাবে? বলা যাবে না আগে। যখন যাই তখন দেখে নিও। বিশ্রাম পর্ব শেষ করে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। এর মধ্যে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। পাইলট মহোদয় ক্লান্ত তাই গভীর নিদ্রায় শায়িত। অগত্যা হোটেল থেকে বের হয়ে আমরা টমটম নিলাম। প্রায় মিনিট বিশেক পর আমাদের তিন চাকার গাড়ি থামল। চারপাশে বেশ ভিড়। গাড়ি থেকে নামলাম আমরা। টমটমের পাইলট সাহেব বললেন, এই হল রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড। চার পাশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রদর্শনী। সানন্দা বলল তুমি যে এত সময় জানতে চেয়েছিলে কোথায় যাচ্ছি আমরা। এই সেই জায়গা, তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে বলিনি।
দূর থেকে মনে হল বিশাল আকৃতির একটি হাঙ্গর হাঁ করে আছে আমাদের দিকে। এই হাঙ্গরের মুখ দিয়েই ফিশ অ্যাকুরিয়াম কমপ্লেক্সের ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। আশপাশে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পুকুর ও সমুদ্রের গভীর তলদেশে প্রাণী বসবাসের চিত্র। রাতের আঁধারে আলোর ঝলকানিতে বেশ ভালোই লাগছিল। আমরা সম্মুখ পানে এগিয়ে চললাম। তিনশ’ টাকার বিনিময়ে টিকিট কিনে ভেতরে প্রবেশ করলাম। রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড ভেতরে প্রবেশ করে মনে হল এ যেন এক অন্য ভুবনে এসে প্রবেশ করেছি আমরা। ডানে, বায়ে আর এদিকে-ওদিক ছুটছে মাছের দল। হঠাৎ বিশাল আকৃতির হাঙ্গরের উপস্থিতিতে আঁতকে উঠছে অনেকে। ধারালো দাঁত বের করে রাক্ষুসে পিরানহা ছুটে আসতে পারে মুহূর্তেই। শরীর ঘেঁষে চারদিকে বিচরণ করছে মাছের দল। এ যেন মাছের রাজ্যে বসবাস। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল আমরা যেন সাগর তলদেশে হাঁটছি। আর আমাদের চারপাশে খেলা করছে বর্ণিল প্রজাতির মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী। প্রতিটি মাছের নাম এবং তাদের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা আছে এখানে। ভেতরে নান্দনিক শিল্পকর্ম। বিভিন্ন ধরনের বাতির আলোর ঝলকানি ঝলমল করছে চারদিক। চোখ ধাঁধানো কারুকাজ।
দুপাশে বিভিন্ন সাইজের অ্যাকুরিয়াম। এসব অ্যাকুরিয়ামে রয়েছে নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, মিঠা পানির মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। এক পাশে দেখা পেলাম মাছকে খাবার খাওয়াচ্ছে। আমরাও তাদের সঙ্গে শামিল হলাম। কিছু দূরে দেখা পেলাম অ্যাকুরিয়ামে রাখা হয়েছে কৃত্রিম প্রবাল। সেই প্রবালের ভেতরে রং-বেরঙের মাছ সাঁতরে বেড়াচ্ছে। বাহারি রঙের লাইটিং করা হয়েছে। মাছগুলো প্রবালের পাশ দিয়ে লেজ তুলে নাচতে নাচতে সাঁতরাচ্ছে। দেখা পেলাম সামুদ্রিক শৈল মাছ, হাঙ্গর, পিতম্বরী, আউস, শাপলা পাতা, সাগর কুচিয়া, বোল, পানপাতা, বোল, পাঙ্গাশ, চেওয়া, কাছিম, কাঁকড়া, জেলি ফিশসহ অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ। সব মাছের নাম মনেও নেই।
আমি একের পর এক ছবিও তুলতে লাগলাম। আমাদের মতো অনেকেই এসেছেন এ মাছের জগৎ দেখতে। দেখা পেলাম কৃত্রিম ঝর্ণারও। এ এক অন্যরকম মুগ্ধতা। নিজের কাছে মনে হচ্ছিল মাছের সঙ্গেই বাস করছি আমরা। দেখতে দেখতে কীভাবে যে দুই ঘণ্টা পার করে দিলাম টেরই পেলাম না।
কীভাবে যাবেন : এই ফিশ অ্যাকুরিয়াম দেখতে আপনাকে যেতে হবে কক্সবাজার। দেশের যে প্রান্তেই থাকুন প্রথমেই চলে আসুন কক্সবাজার। কক্সবাজার দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার পাশাপাশি হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়ে চলে যেতে পারেন এই জলজ জগতে। কক্সবাজারে যেখানেই থাকেন সেখান থেকে অনায়াসে সিএনজি-ইজিবাইক-অটোরিকশা দিয়ে যেতে পারবেন। কলাতলী বিচের সড়কেই পাবেন সব যানবাহান। যেতে হবে ঝাউতলা, প্রধান সড়ক, কক্সবাজার। ইজিবাইক রিজার্ভ নিলে ভাড়া নেবে ৫০-৭০ টাকা। লোকাল ইজিবাইকে ১০-১৫ টাকা দিয়েই একা চলে যেতে পারবেন ঝাউতলা। পৌষী রেস্টুরেন্টের সামনের মোড় থেকে হাতের বাম পাশে অল্প কয়েক কদম গেলেই পেয়ে যাবেন রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড। সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। আগেই বলেছি, প্রবেশমূল্য মাথাপিছু তিন শত টাকা।
