Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

ভ্রমণ

গ্রামীণ আবহে বিজয়নগর

Icon

এসএম কামরুল হাসান শান্ত

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শীতের এ সময়ে গ্রামীণ আবহে ব্যতিক্রমী কিছু উপভোগ করতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থেকে। ছোট ছোট পাহাড়ি টিলা ও লেকের আকৃতিতে ফসলি জমিনের অপরূপ সৌন্দর্যের দৃষ্টিনন্দন মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে বিজয়নগর উপজেলায়। পর্যটন নগরী ও ফলের রাজধানী হিসাবে পরিচিতি হয়ে উঠেছে বিজয়নগর। বর্তমানে চায়না থ্রি, দার্জিলিং কমলা চাষ ও সনাতন পদ্ধতিতে আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে লালি গুড় তৈরির অসাধারণ দৃশ্য দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছে। এ দুটি স্থান এখন পর্যটন স্পট হিসাবে সবার কাছে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে।

বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে রেলপথে আসতে হলে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। সিলেট থেকে ১২০ কিলোমিটার আগে আজমপুর বা মুকুন্দপুর রেলওয়ে স্টেশনে নামতে হবে। যদি ঢাকা থেকে কালোনী এক্সপ্রেসে আসেন তাহলে হরষপুর স্টেশনে নামতে পারেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী বা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী কোনো ট্রেনে উঠে পড়লে আখাউড়া জংশনে নেমে যেতে হবে। উপরে উল্লেখিত যে কোনো স্টেশনেই নামেন সেক্ষেত্রে স্পটে আসার জন্য সিএনজি নিতে হবে।

বিভিন্ন স্টেশন থেকে বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ছতরপুর পূর্বপাড়া খোকন মিয়ার কমলা বাগানের স্পটে আসতে সিএনজি রির্জাভ এলে ২০০-৩০০ টাকা নেবে। রিজার্ভ ছাড়া একা আসলে জনপ্রতি ৩০-৬০ টাকা পর্যন্ত নেবে।

যদি ঢাকা বা সিলেটের কোনো অঞ্চল থেকে বাই রোডে আসেন তাহলে বাস বা প্রাইভেট কার নিয়ে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে রোডের বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা ডাকবাংলা মোড়ে নামতে হবে। অপরদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে এলে কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রোডের সুলতানপুর নামক বাসস্ট্যান্ডে নামলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুবিধা হবে। চান্দুরা ডাকবাংলা মোড় বা সুলতানপুর বাসস্ট্যান্ড যেখানেই নামেন বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ছতরপুর গ্রামের পূর্বপাড়া খোকন মিয়ার কমলা বাগানের কথা বলতে হবে।

দুটি স্পটে একদিনে ঘোরার ইচ্ছা থাকলে শুরুতেই আপনাকে চলে আসতে হবে কমলা বাগানে। কারণ কমলা বাগান সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনের আলোতে ঘোরার উপযোগী। অপর দিকে সনাতন পদ্ধতিতে আখ মাড়াইয়ের স্পট দুপুরের পর থেকে রাত নয়টা-দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে। তাই প্রথমেই দিনের শুরুতে কমলা বাগান ঘুরে দুপুরের পরে বিকালের দিকে কমলা বাগান থেকে ২০-৩০ টাকা জনপ্রতি দিয়ে অটো রিকশায় উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে সনাতন পদ্ধতিতে আখ মাড়ায়ের স্পটে যেতে পারেন।

দুর্ভোগ এড়াতে বলে রাখা ভালো বিজয়নগর উপজেলায় বর্তমানে কোথাও রেস্ট হাউস বা আবাসিক হোটেল নেই। তাই যাদের আসার ইচ্ছা রয়েছে দিনে দিনে ঘুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে। থাকার ইচ্ছা থাকলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের কোনো রেস্ট হাউজ বা আবাসিক হোটেলে অবস্থান নিতে পারেন। বিজয়নগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার।

বিজয়নগর উপজেলার ছতুরপুর গ্রামের খোকন মিয়া চায়না ও দার্জিলিং কমলা চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাগান করেন। বর্তমানে তিনি তার বাগানের চায়না ও দার্জিলিং কমলা চাষে সফল হয়েছেন এবং কমলা চাষে তাদের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর কমলার ফলন ভালো হয়েছে। পুরো বাগানে সবুজ পাতার আড়ালে ঝুলছে হলুদ রঙের কমলা, যা মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। পর্যটকদের খোকন বাগান ঘুরে দেখলে ঘুরতে আসার সার্থকতা শতভাগ পূর্ণ হবে।

ছতুরপুর গ্রামের কমলা চাষি খোকন মিয়া জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে ৬০টি দার্জিলিং ও ১০০টি চায়না থ্রি কমলার চারা রোপণ করে বাগান গড়ে তুলেছেন। ইউটিউব দেখে বাগানের পরিচর্যা করে তিনি ভালো ফলন পেয়েছেন। বাগানের গাছগুলোতে সবুজ পাতার আড়ালে ঝুলছে পাকা রসালো কমলা। খোকন মিয়া আরও বলেন, ‘গত বছর ১ হাজার কেজির বেশি কমলা বিক্রি করেছি। এ বছর দ্বিগুণ ফলন এসেছে। প্রতি কেজি চায়না থ্রি কমলা ১৮০ টাকা কেজি ও দার্জিলিং কমলা ২৫০ টাকা কেজি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। বাগান থেকে ক্রেতারা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত বাজারে গিয়ে বিক্রি করতে হয়নি। দর্শনার্থীরা এসে দেখে বাগান থেকেই কমলা ক্রয় করছেন। বাগান করার সময় গ্রামের অনেকেই বলেছিলেন, এ এলাকায় কমলার চাষ হবে না। আমি মানুষের কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো করে চেষ্টা করেছি। আমার বাগান থেকে এ বছর অন্তত ৫ লাখ টাকার কমলা বিক্রির আশা করছি।’

এ কমলা বাগানে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে ফলন শুরু হয় ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত কমলার ফল থাকবে। বিজয়নগরে কমলা চাষের খবর সংবাদ মাধ্যমে ও সামাজিক সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হলে বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা বাগান দেখতে প্রতিদিনই পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে দলবেঁধে ভিড় করছেন। বাগানে এসে ফটোসেশন, ফেসবুক লাইভ, সেলফি তুলতে মেতে উঠেন। এক পর্যায়ে কমলা বাগান এখন পর্যটনের ভেন্যুতে রূপ নিয়েছে। রঙিন কমলার স্বাদ নিতে ভ্রমণপিপাসুরা আসছেন প্রতিনিয়ত। বাগান পরিদর্শন শেষে টাটকা কমলা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন তারা। কমলা বাগানের এমন দৃশ্য দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় জমান পর্যটকরা। চারদিকে এমন দৃশ্য দেখে এবং বাগানে কমলা খেয়ে তারা তুষ্টির কথা জানান।

কমলা বাগানের ঘোরার শেষে অটো রিকশা নিয়ে আঁকাবাঁকা উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে আখ মাড়াইয়ের স্পটে গেলে সেখানে ভিন্ন আবহ পাবেন। কৃষকরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জমিনে চাষ করা আখ তুলে এনে দুপুরের পর থেকে মহিষ দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে আখ মাড়াই করে প্রথমে রস বের করে পরবর্তীতে পাশে বড় লাকড়ির চুলায় দীর্ঘক্ষণ জাল দেওয়ার মাধ্যমে তরল গাঢ় প্রকৃতির সুস্বাদু লালি তৈরি করে। একই জায়গায় চার-পাঁচজন উদ্যোক্তা পারিবারিক ঐতিহ্য হিসাবে এ কাজটি নিয়মিত করে যান। এ সুস্বাদু লালি দিয়ে সকালের নাশতা রুটিসহ বিভিন্ন পিঠাপুলি খেতে অন্যরকম স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।

কৃষকরা বছরের এপ্রিল-মে’র দিকে জমিতে আখ চাষ করেন। সেটি অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে জমি থেকে উঠিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে আখ মাড়াই করে থাকেন। এ সনাতন পদ্ধতিতে উপজেলার ২০ থেকে ২৫টি পরিবার আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে আখের রস, লালি তৈরি ও সিজনের শেষ দিকে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে তারা আখের গুড় তৈরি করে থাকেন। তাদের মাধ্যমে আরও শতাধিক পরিবারের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম