ভ্রমণ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চন্দ্রনাথ পাহাড়

রাজীব পাল রনী
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বসন্তে ফাল্গুনের হাওয়ায় দোল লাগছে প্রকৃতিজুড়ে। এবার আমাদের ভ্রমণ, জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চন্দ্রনাথ পাহাড় ট্রেকিং করে ঘুরে দেখার। ১ দিনের ছুটি। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার জন্য আমরা ৫ বন্ধু ভ্রমণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। রাত ১২টা। সায়দাবাদ থেকে বাস ছাড়ল। আমাদের বহু প্রতীক্ষিত ট্যুর। বন্ধুদের সবার মধ্যেই প্রাণের উচ্ছ্বাস ছিল প্রচুর। কাকডাকা ভোরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডে বাস থামল। প্রথম গন্তব্য আমাদের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়া দর্শন। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়া ৪ কিলোমিটারের পথ। তখন সীতাকুণ্ডে চলছিল শিবচতুর্দশী মেলা ও উৎসব। ফাল্গুন মাসের শিবচতুর্দশী তিথিতে চন্দ্রনাথ ধামে শিব পূজা উপলক্ষ্যে সীতাকুণ্ডে ঐতিহ্যবাহী বিশেষ পূজার আয়োজন করে থাকে। সীতাকুণ্ড উপজেলাটি শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় তীর্থস্থানই নয়, খুব ভালো ভ্রমণের স্থান হিসাবেও স্বীকৃত। ফ্রেশ হয়ে বাজার থেকে রেললাইন পার হয়ে কিছুটা পথ এগোলেই শংকর মঠ শ্মশান, সীতামন্দির ধর্মশালা দেবালয়। তারপর চলে এলাম রাম-সীতা মন্দিরে। সীতাকুণ্ড জায়গার নামকরণে বিভিন্ন উপাখ্যান থাকলেও কথিত আছে, সীতার ব্যাস কুণ্ডলী থেকে সীতাকুণ্ড নামে পরিচিতি লাভ করে। তা দেখে আমরা চলে এলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার গেটের মুখে। তখন সকাল ৭টা। সম্ভুনাথ মন্দিরের নিচ থেকে ওপরে ওঠার জন্য আমরা অন্য পর্যটকদের মতো পাহাড়ি বাঁশের লাঠি কিনে নিলাম। পাহাড়ে ওঠার জন্য ও পিছলে পড়ে যাওয়ার পথে সহায়ক এ বাঁশের লাঠি। কিছুটা হাঁটার পর আমরা ছোট্ট একটি ঝরনার কাছে এলাম। ঝরনাটিতে পানি নেই শুকিয়ে গেছে। এখানেই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য দুটি রাস্তা চোখে পড়ল। ডানদিকে রাস্তা প্রায় পুরোটাই সিঁড়ি আর বাম দিকে রাস্তাটি পাহাড়ি কাঁচা পথে কিছু ভাঙা সিঁড়ি আছে। আমরা পাহাড়ি কাঁচা রাস্তার পথটি বেছে নিলাম। ট্রেকিং-এর জন্য অন্যতম জনপ্রিয় রুট এটি। অবশেষে এ পথ দিয়েই প্রায় ১১০০ ফুটের উচ্চতার চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ার দিকে ট্রেকিং শুরু করলাম। এ পাহাড়টি দুর্গম হলেও রোমাঞ্চকর। পাহাড়ের যতই ওপরে উঠছি মনে হয় এখানেই পথ শেষ! ওঠার পর আরও পথ ধরে উপরে উঠতে হয়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জেগে ওঠা ঘন সাদা কুয়াশা যেন আমাদের ডাকছে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। যেতে যেতে ওপরের দিকে তাকালে পাহাড়টাকে বিস্ময় মনে হয়। চারপাশ যেন সত্যিকারের আদিমত্তা ঘিরে রেখেছে পুরো প্রাকৃতিক রাজ্য। এগিয়ে যাচ্ছি ঘন জঙ্গল আর প্রাচীন বৃক্ষে ঢাকা সরু পথে। আমাদের মতো হাজার হাজার তীর্থযাত্রী চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটে চলছে দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে। দূর থেকে ছোট ছোট টিলা পাহাড় দেখা যায়। অনিন্দ্য সুন্দরের এক আধার যেন পাহাড়টি ঘিরে রেখেছে। আমাদের সঙ্গে পথে দেখা হয় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকদের। তারা মূলত চন্দ্রনাথে আসে শিবরাত্রির এ বিশেষ দিনে পূজা আর পাহাড়ের সৌন্দর্যের টানে। সূর্যটা বড় আলসেমিতে পেয়েছে আজ। তেজ নেই। তবুও শরীর থেকে অনেক ঘাম ঝরছে। দেখা হলো কয়েকজন সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে। সন্ন্যাসীরা আরধনায় মগ্ন থাকে পাহাড়ে। পাহাড়ে ওঠার পথে দুপাশের প্রকৃতি পর্যটকদের মুগ্ধ করে। পথ চলতে চলতে পাহাড়ি পথে দেখা মিলবে প্রজাপতি আর মৌমাছির দলের ওড়াউড়ি। অনেকটা পথ চলে এসেছি। ক্লান্ত শরীরের বেশ হাঁপিয়ে উঠেছি। বিশ্রাম প্রয়োজন। সামনেই প্রাচীন বটগাছের পাশে বিরুপাক্ষ মন্দির। আমরা এখানে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিলাম এবং চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে আবার রওয়ানা হলাম পাহাড়ের চূড়ার দিকে। এ বিরুপাক্ষ মন্দিরের পূর্ব দিকের পথ ধরে চলে গেছে চূড়ায়। এ সরু পথ ধরে চূড়ায় পৌঁছানো চ্যালেঞ্জিং। তাই ভ্রমণপিপাসু আর অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের এ পথ প্রিয়।
অনেক মানুষের ভিড় পেরিয়ে আমরা প্রায় আড়াই ঘণ্টা পথ অতিক্রম করে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছালাম। আমাদের ভ্রমণ যেন পূর্ণতা পেল। এখান থেকেই দূর সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। পাহাড়ের ওপরে ওঠার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আমাদের সেরা মুহূর্ত। গন্তব্যে পৌঁছার পর নিমিষেই হারিয়ে গেল ভ্রমণের সব ক্লান্তি। পাহাড়ঘেরা নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা মনে পড়ে যায়-‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন উঁচু-নিচু পাহাড়ের নির্জনতা। অদ্ভুত সুন্দর এ প্রকৃতি। প্রকৃতিকে কতটা রঙের তুলি দিয়ে তৈরি করেছেন বিধাতা তা পাহাড়ের বুকে না গেলে অনুভব করা যায় না। এখান থেকে দেখা যায়, তীর্থ যাত্রীদের পাহাড় বেয়ে চন্দ্রনাথ মন্দিরে ওঠার দৃশ্য। দূর থেকে দেখে অনেকটা মানুষের সারি পিঁপড়ার সারির মতো মনে হবে। পাহাড়ি মধুময় প্রকৃতি আমাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে দেয়। চন্দ্রনাথ মন্দির দর্শন করে আমরা প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটাহাঁটি করলাম। সূর্য এখন মাঝ আকাশে এবার নামার পালা। ইট-পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নামা শুরু করলাম। দুর্গম প্রান্তিক পাহাড়ি জনপদে সবুজ বন, বনফুল, প্রজাপতি আর নাম না জানা নানা রকমের পাখির দেখা মিলে। আমাদের নিচে নামার সময় ছবি তুলতে চোখ পড়ে গাছে গাছে ফোটা লাল রঙের শিমুল ফুলের সৌন্দর্য আর গাছের ডালে ও ফুলে বসে থাকা পাখি। ভরদুপুরে এ দৃশ্য আকৃষ্ট করে আমাদের। পেয়ারা, সুপারি, আমগাছসহ বিভিন্ন ফলের বাগান দেখতে দেখতে পাহাড়ে নিচে নেমে এলাম।
শারীরিক ধকল ও ভিন্ন পরিবেশে সবার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। নিচে নেমে আমরা বাস কাউন্টারের বিশ্রাম নিলাম। খাবার খেয়ে ঢাকার পথ ধরলাম। এখানে এসে পাহাড় আর প্রকৃতি নতুন করে চিনেছি, জেনেছি। স্মৃতির ডায়েরিতে যুক্ত হলো আরও একটি ভ্রমণ অধ্যায়।