Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

ভ্রমণ

নজরুলের স্মৃতিঘেরা আটচালা ঘর

Icon

লেখা ও ছবি সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একঘেয়ে ব্যস্ত জীবন থেকে একটু ছুটি সবারই প্রত্যাশিত। শহরের প্রাত্যহিক জীবন আর দূষিত বাতাস থেকে বেরিয়ে নির্মল বাতাসে মন খুলে একটু শ্বাস নিতে পারলে যেন স্বস্তির অন্ত নেই। আমি যেহেতু চাকরিজীবী মানুষ তাই কোথাও যেতে হলে আগে থেকে পরিকল্পনা করতে হয়। আমার অফিসের সহকর্মী মিসবা ভাই আমার মতো ভ্রমণপিয়াসী। সময় পেলেই বেরিয়ে পড়েন অদেখা ভুবন দেখার নিমিত্তে। বেশ কিছুদিন হয় কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। তাই মন চাইছিল কোথাও ছুট দেই। কি করি, কোথায় বা যাই ঘুরতে। অনেক হিসাব-নিকাশ কষে আমরা ঠিক করলাম এবার আমরা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জনপদ চুয়াডাঙ্গা যাব। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিঘেরা আটচালা মাটির ঘর চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত। তাই এবারের আমাদের ভ্রমণ গন্তব্য নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য আটচালার ঘর। ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাতটা। আমরা ত্রিচক্রযানে করে এগিয়ে রেলওয়ে স্টেশন পানে। সুন্দরবন এক্সপ্রেস নির্ধারিত সময়ই স্টেশন ছেড়ে ছুটে চলল গন্তব্য পানে। ‘বাবুদের তালপুকুরে/হাবুদের ডালকুকুরে/সে কি বাস করলে তাড়া,/বলি থাম একটু দাঁড়া।’ কবিতাংশটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ থেকে নেওয়া। এটি চুয়াডাঙ্গার মাটিতে বসেই কবি লিখেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি রাজনৈতিক বা লেটোর দলে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি স্থানে এসেছেন। ময়মনসিংহ (ত্রিশালসহ), কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, বরিশাল বা চুয়াডাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। তিনি এসব স্থানে অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। তার এসব সাহিত্যকর্মের মধ্যে অনেক রচনা অমরত্ব পেয়েছে। চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় (নিশ্চিন্তপুর) বেশ কয়েকবার এসেছেন। এখানেও তিনি কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন।

আমাদের যাত্রীবাহী ট্রেন ছুটে চলছে দৌলতপুর, নওয়াপাড়া, কোটচাঁদপুর পেরিয়ে। পাক্কা সাড়ে চার ঘণ্টায় আমরা এসে পৌঁছালাম চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমেই আমরা পদব্রজে হেঁটে চলে এলাম হোটেল সালাউদ্দিনে পেট পূজার জন্য। সেই সকালে বের হয়েছি এখনো কোনো দানাপানি পড়েনি পেটে। তৃপ্তিসহকারে খেয়ে আমরা এবার পা বাড়ালাম কার্পাসডাঙ্গা বাজার পানে। সেখানে থেকে দুই কিমি দূরে যেতেই দেখা পেলাম কবির স্মৃতিময় বাড়ির। এখানে মূল রাস্তার একেবারে ধার ঘেঁষেই বাড়িটি। প্রাচীরঘেরা বাড়িটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি ফলক। সেখানে অল্প পরিসরে লেখা আছে বাড়িটির ইতিহাস। ভেতরে হলদে সেই আটচালা ঘর। দেখলে মনে হয়, ঘরটি সূর্যের আলোর রং পুরোটাই ধারণ করেছে। এ ঘরেই অনেক দিন কাটিয়েছেন কবি নজরুল। ঘরটির সামনের কিছুটা অংশজুড়ে লেপে দেওয়া উঠান। পাশেই অবহেলায় শুকিয়ে যাওয়া এক ছোট পুকুর। ঝরে পড়া পাতা ও আগাছায় ঢেকে গেছে পুকুরটি। বাড়ির অদূরেই ভৈরব নদী। লোকমুখে শোনা যায়, তৎকালীন দামুড়হুদা উপজেলার ভৈরব নদের তীরবর্তী কার্পাসডাঙ্গা মিশনপাড়ার সরকার পরিবার ছিল জ্ঞান-গরিমায় বেশ সম্ভ্রান্ত। এ পরিবারের সন্তান শ্রী মহিম সরকার চাকরির সুবাদে থাকতেন কলকাতায়। কলকাতা আমহার্স্ট স্ট্রিটে তিনি সপরিবারে বসবাস করতেন। মহিম সরকারের সঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামের খুবই সখ্য ছিল। তার বাড়িতে কবির আসা-যাওয়া ছিল আপনজনের মতো। তার দুই মেয়ে আভা রাণী সরকার ও শিউলী রাণী সরকার নজরুলগীতি চর্চা করতেন। তাদের গানের তালিম দিতেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজে। একাধিক তথ্যসূত্রে জানা যায়, মহিম সরকারের পারিবারিক আমন্ত্রণে একাধিকবার কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় এসেছেন। তবে ১৯২৬ সালে ২৭ বছর বয়সে কবি সপরিবারে এখানে বেড়াতে আসেন। এ সময় প্রায় দুই মাস কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থান করেন। তার সঙ্গে এসেছিলেন শাশুড়ি গিরিবালা, স্ত্রী প্রমীলা ও বড় ছেলে বুলবুল। তারা কলকাতা থেকে ট্রেনযোগে দর্শনায় নেমে ৬ মাইল গরুর গাড়িতে করে কার্পাসডাঙ্গায় আসেন। কার্পাসডাঙ্গা মিশনপাড়ার প্রয়াত শ্রী দ্বারিক নাথ ওরফে তেরেন সরকারের ভাষ্যমতে, কবি কলকাতা এবং কৃষ্ণনগর থেকে কয়েকবার কার্পাসডাঙ্গায় আসেন। কার্পাসডাঙ্গার বিপিন সরকার জানিয়েছেন, কবির সঙ্গে বসে তাস খেলেছেন তিনি। পারিবারিক আমন্ত্রণে কবি নজরুলের কার্পাসডাঙ্গায় আগমন ঘটলেও, স্বদেশি আন্দোলন বেগবান করার জন্য অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে গোপন বৈঠকও তিনি করেছিলেন বলে সে সময়কার অনেকেই মৃত্যুর আগে জানিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে দ্বারিক নাথ ওরফে তেরেন বাবু অন্যতম। তার ভাষ্যমতে, কার্পাসডাঙ্গা মিশন চত্বরে কয়েকটি ঝাউগাছ ছিল। সেই গাছে একদিন একটি বিষধর সাপ দেখতে পান দ্বারিক। সাপটিকে মেরে ফেলেন তিনি। পরে কবি বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন। এ কারণেই কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় রচনা করেন পদ্মগোখরা।

কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম নসকর আলী ১৯৮৭ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন। তখন জীবিত ছিলেন কার্পাসডাঙ্গার মহিম বিশ্বাসের মেয়ে আভা রাণী সরকার ও শিউলী রাণী সরকার। তাদের দুজনের সঙ্গে কথা বলেন নসকর আলী। আভা রাণী ও শিউলী রাণী নিশ্চিত করেন নজরুল কয়েকবার কার্পাসডাঙ্গায় গিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম কার্পাসডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী কুড়ুলগাছির গাঙ্গুলী ও মজুমদার বাড়িতেও কয়েকবার এসেছেন বলেও জানা যায়। কার্পাসডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী কোমরপুর গ্রামের কৃতী লেখক ছিলেন এম ইব্রাহিম। তিনিই নজরুলকে কার্পাসডাঙ্গায় প্রথম কাগজে-কলমে তুলে ধরেন। তার লেখা নজরুল ও নিশ্চিন্তপুর গ্রন্থে নজরুলকে নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। এ গ্রন্থটি ১৯৯০ সালে প্রকাশ করেন এম ইব্রাহিম। যা আগে চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দর্পণ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। আমরা পদব্রজে ঘুরে ঘুরে দেখছি নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থানটি।

কালের প্রবাহে মাটির আটচালা ঘরটি খুব জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়ায় তা ভেঙে ইটের দেওয়াল তোলা হয়েছে। তবে মাটির ঘরের চেহারা অক্ষুণ্ন রাখতে তার ওপর কাদামাটির আস্তর দেওয়া হয়েছে। সেই কাদার আস্তর রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে মাঝে মাঝে খসে পড়ে। তবে প্রতি বছর ঘরটির চাল খড় দিয়ে ছাওয়া হয়। কবি নজরুলের অবস্থানের সময়কার অনেক কিছুরই অস্তিত্ব নেই এখন। তালপুকুরের চারপাশে ছিল সারিসারি তালগাছ। বর্তমানে শুধু পুকুরটিই রয়েছে। পাড়ের তালগাছের কোনো অস্তিত্ব নেই। বাড়িটিতে এখন থাকেন হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের বংশধররা। নিজেদের অর্থ ব্যয় করে নজরুলের স্মৃতিঘেরা ঘরটি টিকিয়ে রেখেছেন তারা। আজ সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশে আটচালা ঘরই হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ঘর নজরুলের স্মৃতি বহন করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। জাগতিক বিচ্ছেদের পরও নজরুল তার কর্মে বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়ে। আর এ আটচালা ঘর তার অস্তিত্বের জানান দিতে স্বমহিমায় আজও দাঁড়িয়ে আছে।

কীভাবে যাবেন : দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ট্রেন বা বাসে চুয়াডাঙ্গা বা দর্শনায় নামতে হবে। এরপর উভয় স্থান থেকে সড়কপথে ছোটগাড়িতে বা অটোতে ১০-১২ কিমি দূরের কার্পাসডাঙ্গা বাজার।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম