|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
নজরুলকে অনুভব করার জন্য এই ক’লাইনই যথেষ্ট নয়! রক্ত টগবগ করা এমন সব কবিতা লিখেছেন যিনি, তিনিই আবার লিখেছেন কতশত প্রেমময় পঙ্ক্তি। কবি স্বভাবের যতগুলো দিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব, তিনি দিয়েছেন। শুধু কি কবিতা, তার গল্প, গান কিংবা উপন্যাসেও সমানভাবে উঠে এসেছে হৃদয়ের আবেদন। কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের অন্যতম অংশীদার। আজ তার লেখা, তার জীবনযাপন কত কী নিয়ে গবেষণা হয়। অথচ তার জীবনটা ততটাও মসৃণ ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেননি। কিন্তু তার লেখার কোথাও তার ছাপ নেই। জন্মের শতবর্ষ পরে এসেও কাজী নজরুলের আধুনিক চিন্তাধারা তাই আমাদের প্রভাবিত করে।
দ্রোহ আর প্রেমের কবি নজরুল। তাকে আমরা ধারণ করে চলেছি নানাভাবে। এমনকি আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনেও অংশ হয়ে রয়েছেন তিনি। কফির মগে নজরুলের পদ্য থেকে শুরু করে টি-শার্ট, কতভাবে রয়ে গিয়েছেন তিনি! আমাদের ফ্যাশনেও সরব কাজী নজরুল। তার মতো মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল এখনো বহু তরুণের আরাধ্য। নজরুলের পাঞ্জাবি কিংবা চাদর তো পুরুষের সৌন্দর্য আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। বিদ্রোহী পুরুষও কীভাবে প্রেমময় হয়ে উঠতে পারেন, সে তো তার নানা লেখা পড়লেই বোঝা যায়। শুধু কি পুরুষ, তার লেখায় নারীর ব্যক্তিত্ব, নারীর সাজ ও সৌন্দর্য যেভাবে ফুটে উঠেছে, সেভাবে খুব কম কবিই প্রকাশ করতে পেরেছেন।
নজরুলের সময়ে সমাজে নারীর অবদানের স্বীকৃতি ছিল না। নারীকে ভাবা হতো পরনির্ভরশীল ও দুর্বল। অথচ নজরুল ঘোষণা করেছেন নারীর ত্যাগ ও মহিমার কথা। বলেছেন, ‘সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’
নজরুলের নায়িকাদের প্রসঙ্গ এলে ফিরে দেখতে হয় ১৯২০ থেকে ১৯৩৫ সালের দিকে। অর্থাৎ শতবর্ষ পার হয়ে গেছে! খুব স্বাভাবিকভাবেই ফ্যাশন ও জীবনযাপনে এসেছে অনেক পরিবর্তন। তবু কোথাও একটা মিল রয়ে যায়। কারণ নজরুল তার নায়িকাদের সাজের বাহুল্য দেননি। স্নিগ্ধ ও সরলতার প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন তার লেখায়। দীপ্তিময়ী সেসব নারীর সাজকে নানা প্রসাধনীর আবরণে ঢেকে দেননি। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটুকুতেই রয়েছে মিল। তখনো মানুষ শিকড়ের কাছে ফিরতে পছন্দ করত, এখনো তাই। নজরুলের নায়িকাদের পোশাকের দিকে খেয়াল করলে ব্লাউজের কুঁচি দেওয়া লম্বা হাতা, অথবা ঘটিহাতা বেশি চোখে পড়ে। আবার তাতে লেইসের কারুকাজও কালের ফ্যাশন সচেতনতার সাক্ষী হয়ে থেকে যায়। চিকন পাড়ের তাঁতের শাড়ি অথবা মোটা পাড়ের রঙিন জমিনের শাড়ি পরিচিত বাঙালি নারীরই প্রতিচ্ছবি যেন!
কাজী নজরুল ইসলাম আর্থিক কষ্টে থেকেছেন। জীবনে নানাভাবে দরিদ্রতা তাকে আঘাত করেছে। তবে নিজেকে খেলো করে তোলেননি তিনি। বরং সব সময় পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করতেন। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে পরতেন ঝলমলে রঙিন পোশাক। এ ধরনের পোশাক পরার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, ‘অনেক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য রঙিন পোশাক পরি। ঝলমলে পোশাকের প্রসঙ্গে বলতেন, ‘আমার সম্ভ্রান্ত হওয়ার দরকার নেই। আমার তো মানুষকে বিভ্রান্ত করবার কথা!’
বিভ্রান্ত না করলেও মুগ্ধ তো তিনি করেছেনই। গোটা একটা জাতিকে বিদ্রোহ ও একইসঙ্গে ভালোবাসার দীক্ষা দিয়ে গেছেন তার লেখায়। তাই তো তার জন্মের শতবর্ষ পরেও তারই কবিতার লাইন টি-শার্টের বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় স্বপ্নবাজ তরুণরা। নজরুলের লেখায় এখনো রক্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা! নারীর আঁচলে শোভা পায় নজরুলের লেখা কোনো কবিতার পঙ্ক্তি। এখনো প্রথম প্রেমকে মানুষ ফুটিয়ে তোলে নজরুলের ভাষায় ‘তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়-লেখা, এইটুকু হোক সান্ত্বনা মোর, হোক বা না হোক দেখা’। এখনো নজরুলের ভাষায় প্রিয়তমাকে করে আহ্বান-‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’।
