Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

ভ্রমণ

শতবর্ষী নৌকার হাট

Icon

লেখা ও ছবি : সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঘড়ির কাঁটায় সকাল দশটা বেজে পনেরো মিনিট। মোবাইল ফোন বেজে উঠল। বারে শনিবার। আলসেমি ঘিরে ধরেছে। অনেক কষ্টে চোখ মেলে দেখি সত্যদা’র ফোন। অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠলেন আজ তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। তা না হলে আজও নৌকার হাট দেখা যাবে না। আমি বললাম ঠিক আছে, আমি দুটোর ভেতর তৈরি হয়ে নেব। দ্রুত হাতের কাজ শেষ করে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম।

আজ আমরা যাচ্ছি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর বাজারে নৌকার হাট দেখতে। প্রতি বছরই বৈশাখের শুরু থেকে নৌকার হাট বসে এখানে। ক্রেতা ও বিক্রেতার বেশিরভাগ এই তিন উপজেলার মানুষজনই থাকেন। বৈটাখাল, নিয়াইন, লেঙ্গুড়া ও গোয়াইনঘাট এলাকার বিক্রেতারা বেশি নৌকা নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। তবে ক্রেতার ক্ষেত্রে এ উপজেলাগুলো ছাড়াও হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখান থেকে এসে নৌকা কিনে নিয়ে যান। আশ্বিন মাস পর্যন্ত চলে এ নৌকার হাট। সবার মনেই একটু তাড়া। কেননা, গত সপ্তাহে ভ্রমণ গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাতে দেরি হওয়ার কারণে নৌকার হাট দেখতে পারিনি। কারণ, নৌকার হাট প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার বসে এবং তা আবার সকাল এগারোটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত থাকে। আমরা জিন্দাবাজার, আম্বরখানা পেরিয়ে এগিয়ে চলছি। কিন্তু পথে বেশ যানজট। তাই একটু বেগ পেতে হলো আমাদের। মালিনিছড়া পেরিয়ে রাস্তা ফাঁকাই পেলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন সাড়ে তিনটা। আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

আমাদের বাহন থেকে নামতেই মানুষের বেশ ভিড় চোখে পড়ল। সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে শখানেক নতুন ও পুরোনো নৌকা। অনেকেই দুই-তিনটি নৌকা একসঙ্গে বেঁধে আবার অনেকেই একটির ওপর আরেকটি নৌকা নিয়ে হাটে আসছেন। নৌকা খালে বেঁধে রেখে পাশেই সড়কে ছাতা নিয়ে বসে রয়েছেন বিক্রেতারা। দাঁড়িয়ে দরদাম করছেন ক্রেতারাও। সড়কের অপর পাশে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা নৌকার বৈঠা। কেউ নৌকা কিনার জন্য দরদাম করছেন আবার কেউ নৌকা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আর আমি একের পর এক ছবি তুলছি। ‘বাজারের বয়স শত বছর। সিলেট জেলার তিনটি উপজেলার মিলনস্থলে সালুটিকরের অবস্থান। যেন এক হাটে গিয়ে তিন উপজেলায় পদচারণ। সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়া চেঙ্গেরখাল নদকে ঘিরে এ হাটে বসে নাওবাজার। সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার মিলনস্থল সালুটিকরে যাতায়াতের ব্যবস্থাটাও নাও-নদীময়।

চেঙ্গেরখাল নদ ঘিরে হাওর এলাকায় সংযোগ হয়েছে নৌপথের। বর্ষায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও যেন বিড়ম্বিত। জলমগ্ন হাওর-জলাশয় আর নিচু ভূমি এলাকা নৌকা দিয়ে সহজে পাড়ি দেওয়া যায় নৌপথে। তাই তো নৌকার কদর। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতায় জমজমাট হয়ে ওঠে নৌকার হাট। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত নৌকা নিয়ে আসতে থাকনে বিক্রেতারা।’ -বলছিলেন স্থানীয় এক বাসিন্দা মোকাদ্দেস আলী। নৌকার হাটে দেখা যায়, ভালো কাঠের তৈরি নৌকার দাম বেশি। ষোলো ফুট প্রস্থ ও আড়াই ফুট লম্বা প্রতিটি নতুন নৌকা বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ নয় হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন চার হাজার টাকায়। পুরোনো নৌকাও বিক্রি হয়। এগুলোর দর ছয় হাজার থেকে সর্বনিম্ন তিন হাজার টাকা। নৌকা কিনে কেউ পানিপথে আবার কেউ ট্রাক কিংবা হিউম্যান হলারে করে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের এলাকায়। এ হাটে মৌখিকভাবে নৌকা কেনা যায় না। বিক্রেতাদের পক্ষ থেকে এ হাটের এজারাদের মাধ্যমে রশিদ নিয়ে নৌকা কিনতে হয়। মোকাদ্দেস আলীর কথায় বিশ্বাস হচ্ছিল না আসলেই কি শত বছর ধরে চলে আসছে এ বাজার জানতে চাইলাম আরেকজন স্থানীয় লোকের কাছে তিনি বললেন একই কথা। নির্দিষ্ট কোনো সন তারিখ জানা নেই তাদের। তবে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ দেশের সর্ববৃহৎ একটি পাথর কোয়ারি। সেখানে পাথর উত্তোলনে বারকি নৌকার ব্যবহার থেকে সালুটিকরে নাওবাজার প্রতিষ্ঠা হয়।

সুনামগঞ্জের মাইজবাড়ি গ্রাম নৌকা তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। এক সময় সব নৌকার জোগান সেখান থেকে হতো। এখন সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় নৌকার চাহিদা কমে গেছে। পানি বেশি থাকলে এখানে চড়কখালে নৌকার হাট বসে। আর পানি কম থাকলে ভেতরে লামার বাজার দামারি বিলে হাট বসে। আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি, দেখা পেলাম কয়েকজন জড়ো হয়ে বসে বৈঠা বানাচ্ছে। তারা বললেন, বিক্রেতাদের অনেকেই আবার নৌকা তৈরির সঙ্গে জড়িত। তাদের পরিচিতি ‘আলংদার’ (নৌকার মিস্ত্রি)। তিনজন আলংদার ও দুজন সহযোগী মিলে এক দিনে একটি নৌকা তৈরি করা যায়। সাধারণ নৌকা ছাড়া বারকি বা অন্য কোনো নৌকা তৈরিতে সপ্তাহখানেক সময় লাগে। এসব নৌকার ক্রেতারা বেশি গ্রামীণ সাধারণ পরিবারের। যাতায়াত আর বর্ষায় বাড়তি পেশা মাছ ধরার কাজের জন্য নৌকা কেনেন তারা। নতুন নৌকার সঙ্গে পুরোনো নৌকা সংস্কার করে চলে কেনাবেচা। আমাদের বাহনের পাইলট সত্য’দা বললেন, সামনে হাট আছে, সেখানে গ্রামীণ অনেক কিছু বসে আর সঙ্গে পাবেন টাটকা শাকসবজি-মাছ। আমি ভাবলাম মন্দ হয় না। এসেছি যেহেতু গ্রামীণ হাটটা ঘুরেই দেখে যাই। চললাম হাটের পানে। শত শত মানুষের পদচারণায় মুখরিত, হাটবার তাই এ অবস্থা। নানা ধরনের কুটির পণ্যের দেখা পেলাম। গ্রামীণ মহিলারাও বসেছেন তাদের হাতের তৈরি পণ্যসামগ্রী বিক্রি করার জন্য। কিছুদূর এগিয়ে যেতে দেখা পেলাম মাছের বাজারের। বর্ষাকাল তাই মাছের বাজারও সরগরম। দরদাম করে দেখলাম শহর থেকে কম দামই। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো মাছগুলো তরতাজা। ঘণ্টাখানেক আগেই নদী থেকে ধরা হয়েছে। তাই মাছ মহোদয় এখনো লম্ফঝম্প করছে। এদিকে ঘড়ির কাঁটা আমাদের বলছে ফিরে যেতে হবে আমাদের নীড়ে। তাই আর অপেক্ষা না করে ফিরে চললাম আমাদের নীড়ে।

যাবেন কীভাবে-ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি বাসে অথবা ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তঃনগর পারাবাত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন সিলেটের পথে ছোটে ভাড়া ৩৬০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। সিলেট শহর থেকে মাত্র ১৩-১৪ কিলোমিটার দূরে সালুটিকর বাজার। সিলেটের আম্বরখানা ইস্টার্ন প্লাজার সামনে থেকে সিএনজি অটোরিকশা করে সে বাড়িতে যাওয়া যায়। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৫০ টাকার মতো। আর গাড়ি ভাড়া করে যেতে চাইলে ভাড়া পড়বে ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম