একাত্তরের সব বধ্যভূমি শনাক্ত হয়নি ৪৮ বছরেও
একাত্তরের গণহত্যার সাক্ষী বধ্যভূমি-গণকবরগুলো এখনও পড়ে রয়েছে অযত্নে-অবহেলায়। অনেকগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্যবহৃত বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ (২য় পর্যায়) এবং ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (১ম পর্যায়)’ কার্যক্রম শুরু করলেও কাজের অগ্রগতি চলছে ধীরগতিতে। লিখেছেন-
রীতা ভৌমিক
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সেনারা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নির্দেশে একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারসহ ঢাকার নিরীহ বাঙালির ওপর গণহত্যা চালায়। এটি ছিল বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত গণহত্যা। সেই সঙ্গে ২৬ মার্চের মধ্যে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশের বড় বড় শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ সার্চলাইট অপারেশনের উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালি পুলিশ, বিডিআর আর সামরিক বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। একাত্তরের মার্চের শুরুতে অপারেশন সার্চলাইটের মূল পরিকল্পনায় ছিলেন ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা বাঙালির ওপর নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড চালায়। যে জায়গাগুলোয় পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালির ওপর হত্যাকাণ্ড চালায় সে জায়গাগুলো মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি নামে পরিচিত। অনেক মানুষ হত্যা করে যেখানে কবর, মাটি চাপা দেয়া হয়েছে তা গণকবর নামে পরিচিত। একাত্তরের বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণ কমিটি ১৯৯৬ সালে দেশব্যাপী নিবিড় জরিপ চালিয়ে বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের দ্বারা সারা দেশে জেলাভিত্তিক ২০১৬ জুন থেকে ২০১৯ জুন মেয়াদকালে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্র জরিপ গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর আওতায় ২০টি জেলার ২০টি ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্র জরিপ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাকি জেলার জরিপ গ্রন্থের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ছাড়া গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র থেকে গণহত্যা সিরিজের আওতায় ১০০টি গণহত্যাবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (১ম পর্যায়)’ বাবদ জুন ২০১৮ তে ৪৬০ কোটি ৯৭ লাখ ৮৯ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। গণপূর্ত অধিদফতর অনলাইনে প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৫ হাজার ৭০৩ জনের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে। তাদের মধ্যে বেসামরিক শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ২ হাজার ৮৬৯, সশস্ত্র বাহিনীর ১ হাজার ৬০৩, বিজিবির ৮২০ এবং পুলিশ সদস্য ৪১১ জনের কবর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা হবে। এ ছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২০ হাজার কবর-সমাধি চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনা ইউনিট এবং গণপূর্ত অধিদফতর যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের দ্বারা মুক্তিযোদ্ধারা যেসব স্থানে শহীদ হয়েছেন সেসব সমাধিস্থলের সংরক্ষণ ও উন্নয়নই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এ ছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ (২য় পর্যায়) বাবদ মে ২০১৮ সালে ৪৪২ কোটি ৪০ লাখ ১৩ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ২৮০টি বধ্যভূমির আকার ও প্রকৃতি ভিন্ন হলেও ডিপিপিতে সব বধ্যভূমির জন্য একই পরিমাণ অর্থাৎ ১০ শতক জায়গা সংরক্ষণ করার প্রস্তাব করা হয়। প্রতিটির জন্য পূর্ত কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। সরকারি মালিকানাধীন জমিতে বিদ্যমান বধ্যভূমির জমির মূল্য ২৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হলেও পিইসি সভায় এ জমি প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়। এ দুটি কাজের মেয়াদকাল ২০১৮-এর জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত।
২০১৮ সালের জুনে এর উদ্যোগ নিলেও ২০১৯ সালের শেষ পর্যায়ে এসেও এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। কোন কোন স্থানের বধ্যভূমি, গণকবরের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা হবে এর সঠিক সংখ্যাও নির্ণয় করা হয়নি। অনেক বধ্যভূমি, গণকবর অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অনেকে বধ্যভূমি-গণকবরে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক জায়গায় বধ্যভূমি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিলুপ্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং প্রজেক্ট পরিচালক মো. মোজাম্মেল হক বলেন, সরকার বধ্যভূমি, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) ১ম পর্যায় জুন ২০১৮ উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রকল্পটি গণপূর্ত অধিদফতরের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পে দেশের ৫৫টি জেলায় ২৮০টি বধ্যভূমি অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। ব্যক্তিগত, খাস এবং অন্য সংস্থার জমিতেও বধ্যভূমি, গণকবর রয়েছে। এটি বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এখনও নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি এর কারণ কাগজে-কলমে শুরু হতে হতেই এক বছর চলে গেছে। দেশব্যাপী বধ্যভূমিতে একটি নির্ধারিত নকশায় স্মৃতিস্তম্ভ করা হবে।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংগ্রহের জন্য সরকার পৃথক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ ছাড়া অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সংরক্ষিত ৪০ হাজার কবর করা হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে ২০ হাজার কবর সংরক্ষিত হবে। তাতে ২ হাজার ৯৩৮ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। এর বাইরেও যদি প্রমাণিতভাবে কোনো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর থাকে সেগুলোও অন্তর্ভুক্তি করা হবে। পরবর্তী সময়ে যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেছেন তাদের কবরও সরকার একই নকশায় সংরক্ষণ করবে। গণপূর্ত অধিদফতরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করার। প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মাটি পরীক্ষা হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। ডিজিটাল সার্ভে, ২৫টি বধ্যভূমির স্থাপত্য নকশা অনুমোদন করা হয়েছে। এখন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাবে।
