আইসিডিডিআর,বি গবেষণা
নবজাতকদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশে নবজাতকদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপক উপস্থিতি (কলোনাইজেশন) শনাক্ত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জীবন রক্ষাকারী ওষুধের কার্যকারিতা রক্ষায় শক্তিশালী নজরদারি, হাসপাতাল সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং যুক্তিসঙ্গত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়ছে। ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ইন কমিউনিটিজ অ্যান্ড হসপিটালস (আর্চ)’ শীর্ষক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার মহাখালী আইসিডিডিআর,বি-এর সাসাকাওয়া মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবেলা : আর্চ গবেষণার ফলাফল’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল ইউনিটের সহায়তায় পরিচালিত গবেষণাটিতে অর্থায়ন করেছে ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং দ্য টাস্কফোর্স ফর গ্লোবাল হেলথ (টিএফজিএইচ)। সেমিনারে আইসিডিডিআর,বি-এর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) গবেষণা ইউনিটের প্রধান ও সহযোগী বিজ্ঞানী ড. ফাহমিদা চৌধুরী গবেষণা ফলাফল তুলে ধরেন।
সেমিনারে জানানো হয়, বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও এই গবেষণাটিই প্রথম। এটি স্থানীয় এলাকা ও হাসপাতাল উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বা কলোনাইজেশন পদ্ধতিগতভাবে তদন্ত করে। কলোনাইজেশন বলতে শরীরে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বোঝায় যা তাৎক্ষণিক রোগের কারণ হয় না। তবে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো পরবর্তীতে তার নিজের শরীর বা আশপাশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা চিকিৎসা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সেমিনারে জানানো হয়, ২০১৯ সালে শুরু হওয়া গবেষণাটির প্রথম পর্যায়ে সুস্থ ব্যক্তি এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। কমিউনিটি বা লোকালয়ে থাকা ৭৮ শতাংশেরও বেশি সদস্য যারা আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ ছিল এবং হাসপাতালের ৮২ শতাংশ রোগীর দেহে এক্সটেন্ডেড-স্পেকট্রাম সেফালোস্পোরিন-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরিয়াল ছিল।
গবেষণায় হাসপাতালে ভর্তি ৩৭ শতাংশ এবং কমিউনিটির ৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরিয়াল (সিআরই) পাওয়া যায়। কমিউনিটির ১১ শতাংশ এবং হাসপাতালের ৭ শতাংশ রোগীর মধ্যে কলিস্টিন-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরিয়াল পাওয়া গেছে। এছাড়াও, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন অংশগ্রহণকারীর দেহে মেথিসিলিন-প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস (এমআরএসএ) ছিল। ২,৬০০টিরও বেশি ব্যাকটেরিয়ার জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য দেখা যায়। যা নির্দেশ করে যে একটি স্ট্রেইনের (ধরন) বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক অন্যটির বিরুদ্ধে কাজ নাও করতে পারে।
২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া গবেষণাটির দ্বিতীয় পর্যায়ে সংকটাপন্ন রোগী, নবজাতক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর এএমআর-এর প্রভাব সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ভর্তি হওয়া নবজাতকদের ৮১ শতাংশের শরীরে (মোট ৪২৩ জনের মধ্যে ৩৪২ জন) কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী ক্ল্যাবসিয়েলা নিউমোনি (সিআর-কেপিএন) জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক একটি অগ্রাধিকার প্যাথোজেন হিসেবে চিহ্নিত। এই নবজাতকদের অর্ধেকেরও বেশি (৭০ শতাংশ, ১৮৫ জন) হাসপাতালে ৪৮ ঘণ্টার বেশি থাকার পর সিআর-কেপিএন দ্বারা কলোনাইজড হয়েছিল, যা হাসপাতাল থেকে সংক্রমণ ঝুঁকির বিষয়টি নিশ্চিত করে। প্রাপ্তবয়স্কদের আইসিইউ-তে ৬০ শতাংশ রোগীর দেহে সিআরই ছিল এবং কলোনাইজড রোগীদের সংক্রমণ হওয়ার ও হাসপাতালে দীর্ঘ সময় থাকার সম্ভাবনা বেশি ছিল।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসাবে অনলাইনে যোগ দেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ড. মো. সায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি এই গবেষণার ফলাফলগুলোকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং একই সঙ্গে মূল্যবান বলে মনে করি। এগুলো আমাদের কৌশল ও ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতিকে আরও সূক্ষ্মভাবে সাজাতে সাহায্য করবে। আমরা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবেলায় সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আইসিডিডিআর,বি-এর নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ, ইউএস সিডিসি-এর ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ব্রায়ান হুইলার, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরিন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ সায়িদুল হক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, হাসপাতাল ব্যবস্থাপক এবং উন্নয়ন সহযোগীরা উপস্থিত ছিলেন।
