Logo
Logo
×

দ্বিতীয় সংস্করণ

রাজধানী থেকে জেলা শহর নিরাপদ নয় নারী-শিশু

পাবলিক প্লেসে যৌন নির্যাতনের শিকার ৯৭ শতাংশ নারী ও কন্যাশিশু * নারী-শিশুর যৌন নির্যাতন বাড়ছে ঘরে-বাইরে * ৬২ শতাংশ নারী রাতে ঘর থেকে বের হতে চান না

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানী থেকে জেলা শহর নিরাপদ নয় নারী-শিশু

রাজধানীসহ জেলা শহরগুলো নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য নিরাপদ নয়। পাবলিক প্লেসে ৯৭.৯৬ শতাংশ নারী ও কন্যাশিশু এক থেকে একাধিকবার যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। রোববার রাতে রাজধানীর কুর্মিটোলায় সড়কের পাশে ফুটপাত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়।

এমন বর্বর ধর্ষণকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা সোচ্চার হয়ে উঠছেন।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ সূত্রে জানা যায়, ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের কারণে রাতে ঘর থেকে বের হতে চান না ৬২ শতাংশ নারী। তাছাড়া একা ঘরের বাইরে যেতে চান না ৬০ শতাংশ, নির্দিষ্ট এলাকা এড়িয়ে চলেন ৪৭ শতাংশ, নির্জন ও জনবহুল স্থান এড়িয়ে চলেন ২৬ শতাংশ, গণপরিবহনে চড়া এড়িয়ে চলেন ১৩ শতাংশ এবং রঙিন পোশাক পরা ছেড়ে দিয়েছেন ২১ শতাংশ নারী। আর জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম সূত্র, প্রায় ৯৮ শতাংশ নারী ও কন্যাশিশু পাবলিক প্লেসে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তঘেঁষা মন্দবাগ এলাকার এক গৃহবধূ বলছিলেন, আমি সবচেয়ে ভয়ে থাকি চারপাশের মানুষরূপী হিংস্র প্রাণীদের নিয়ে। মেয়েটি চোখের আড়াল হলে যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে ধর্ষণ শেষে খুন হতে পারে। মিরপুরের এক গৃহবধূ বলেন, তার বড় মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ভয়ভীতি আর সম্মানের ভয়ে কাউকে বলিনি। একটি ব্যাংকে ঊর্ধ্বতন পদে চাকরি করা এক নারীর বক্তব্য, মেয়ে বন্ধুদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এখন দেশের বাইরে পড়াচ্ছি। একজন মা বললেন, শিক্ষক দ্বারা তার দুই মেয়েই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাধ্য হয়েই এখন বাসাবদল করে অন্য স্কুলে পড়াচ্ছি। রাজধানীর একাধিক ছাত্রী বলেছেন, রাত কিংবা দিন কখনও তারা নিরাপত্তা বোধ করেননি। হিংস্রতা তাদের তাড়া করে বেড়ায়। বললেন, সরকার, সমাজ, পরিবারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে- রাজধানী, শহর, বাহির কিংবা অন্দরমহলেও নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার-ওসিসির কো-অর্ডিনেটর ডা. বিলকিস বেগম জানান, সম্প্রতি রাজধানীতে যৌন নির্যাতনের শিকার চার মাসের একটি কন্যাশিশুকে ওসিসিতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। বললেন, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুরা ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে বেশি চিকিৎসা নিয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিনই কমপক্ষে ১৩-১৪ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন। বছরজুড়েই ছিল নারী শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, ধর্ষণ শেষে হত্যাসহ নারী-শিশু হত্যার ঘটনা। প্রতিনিয়তই ধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে হত্যার খবর উঠে এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, শিশু অধিকার ফোরামসহ বিভিন্ন এনজিও উন্নয়ন সংগঠনের তথ্য- প্রতিবছরই নারী শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা বাড়ছে। আর বিভিন্ন গণমাধ্যম শিরোনামে না আসা নারী শিশু ধর্ষণের সংখ্যাটা আরও বহুগুণ বেশি। ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্য- গত বছর শুধু প্রতিবেশী দ্বারা ২৪০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

আসকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে দলবেঁধে ধর্ষণের পর ৭৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর ১০ জন আত্মহত্যা করেছে। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৭৩২ জন। ছেলেশিশু বা কিশোরদের ওপরও যৌন নির্যাতনের সংখ্যা বাড়ছে বলেও সূত্র বলছে।

আসকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের শুরু থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পারিবারিক সহিংসতার শিকার অর্থাৎ স্বামী দ্বারা ৩২৫ জন নারী হত্যার শিকার হয়। তাছাড়া প্রতি মাসে প্রায় ৫টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আত্মহত্যার মূল কারণই ছিল স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজন দ্বারা নির্যাতন এবং যৌতুক না দেয়ার কারণে। গত ১২ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জ সদরে স্বামীর বাড়িতে খাটের নিচে খাদিজা আক্তার (২১) নামের এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। তার পরিবারের অভিযোগ- মেয়েকে মেরেছে স্বামী ফরহাদ। বিদায়ী বছরে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে। নির্যাতনের ঘটনার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা।

ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট, ফেসবুক, মেসেঞ্জারের মাধ্যমে তরুণীরা নানা ধরনের মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, মূলত ফেসবুক হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইল করা এবং বাজে লেখা-ছবি পাঠানোর মাধ্যমে। বিদায়ী বছরে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমন অভিযোগ এসেছে আড়াই হাজারের বেশি, যা গত বছরের অভিযোগের দ্বিগুণের কাছাকাছি।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী জানান, বিদায়ী বছরের ৮ মাসেই ৬৯৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা ২০১৮ সালের ১২ মাসে ছিল ৬৮৩ জন। তিনি বলেন, কন্যাশিশু ধর্ষণের সঙ্গে ছেলেশিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সব মিলিয়ে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে গত প্রায় এক দশক ধরে। কিন্তু, গত ৩ বছরে সংখ্যাটা লাফিয়ে বেড়েছে। এটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।

নিজেরা করির সমন্বয়কারী মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির জানান, রাজধানীসহ জেলা শহরগুলো নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। অন্দরমহলেও তারা ধর্ষণসহ নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ বর্বরতা প্রতিরোধে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম জানান, দেশে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে প্রায় দ্বিগুণ ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। অধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্ষণ আইনের সংশোধন ও সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এমন বর্বর ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান বলেন, সমাজে শিশুকন্যা থেকে শুরু করে তরুণী, ছাত্রী, নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পরিবার থেকে সন্তানদের শেখাতে হবে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

নারী-শিশু

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম