ফের সক্রিয় জিসান-মেহেদী গ্রুপ
সরকারদলীয় নেতারাই শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের নেপথ্যে
চাঞ্চল্যকর তথ্য গ্রেফতার ৩ জনের
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাড্ডাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান এবং মেহেদী গ্রুপসহ একাধিক চক্র। আর এদের নেপথ্যে কাজ করছে সরকারদলীয় সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। শনিবার রাতে মধ্য বাড্ডা রাতুল মোর্শেদ এন্টারপ্রাইজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে জিসান গ্রুপের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে বাড্ডা থানা পুলিশ। তারা হলেন-আমজাদ হোসেন সোহেল ওরফে চাকু সোহেল, মহিউদ্দিন মহি এবং জাহিদুল ইসলাম। তাদের বিরুদ্ধে করা অস্ত্র এবং দস্যুতার মামলায় রোববার আদালতে হাজির করে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানায় পুলিশ। এর আগে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন সন্ত্রাসী দলের গ্রেফতারকৃত সদস্যরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বাড্ডা থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসিন গাজী যুগান্তরকে বলেন, এলাকায় চুরি ও ছিনতাই প্রতিরোধ টিম ডিউটি করার সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে, মধ্য বাড্ডা রাতুল মোর্শেদ এন্টারপ্রাইজ এলাকায় কিছু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অস্ত্র-গুলিসহ অবস্থান করছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালানো হয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর সময় তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের হেফাজত হতে পাঁচ রাউন্ড গুলি, একটি মোটরসাইকেল ও একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ওরফে হাজী গ্রুপের সক্রিয় সদস্য বলে স্বীকার করেছেন। গ্রেফতারকৃত চাকু সোহেলের বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরখান এবং দক্ষিণখানসহ বিভিন্ন থানায় নয়টি মামলা আছে বলে ওসি জানান।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, বাড্ডা এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কাজ করে আবুল বাসার প্রকাশ ওরফে বাদশা (৪৫)। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার নাম মো. আবুল বাশার। শনিবারের অভিযান চলাকালে বাদশা ঘটনাস্থলে ছিলেন। পুলিশ তাকে ধরতে না পারলেও মামলায় পলাতক আসামি হিসাবে উল্লেখ করেছে। বাদশার বাবার নাম জহির আলী। মা হজেরা বেগম। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায়। থাকেন বাড্ডা লিংক রোডে। তিনি বাড্ডা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার ব্যবসায়িক পার্টনার যুবলীগ নেতা জাকির ও ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি জিসানসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করছেন। পুলিশের খাতায় তিনি চাঁদাবাজ এবং সন্ত্রাসী হিসাবে লিপিবদ্ধ হলেও তিনি কখনো গ্রেফতার হননি। যুবলীগ নেতা জাকির এবং মহারাজ তার সহযোগী হিসাবে কাজ করেন। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে গুদারাঘাট এবং দক্ষিণ বাড্ডার বিভিন্ন এলাকা।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জিসান গ্রুপের আরও যেসব সদস্যের নাম বেরিয়ে এসেছে তারা হলেন-মালিবাগের শামীম, উত্তর বাড্ডার শফিকুল ইসলাম ওরফে রেহলার, বাড্ডা থানা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক কাওসার, ২১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মহারাজ, একই ওয়ার্ডের যুবলীগ সভাপতি জাকির, বরিশাইল্যা শান্ত, নাহিদ, তেজগাঁওয়ের মামুন, আদর্শনগরের আরিফ, মধ্য বাড্ডার কানা কাউসার এবং সায়মন।
পুলিশ জানায়, গুলশান এবং বাড্ডা এলকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জিসান এবং মেহেদী গ্রুপ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রুপগুলোর মধ্যে আছে সাবেক যুবলীগ নেতা চঞ্চল গ্রুপ এবং ডালিম-রবিন-মাহাবুব গ্রুপ। যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক মিল্কি হত্যার পর চঞ্চল বিদেশে পালিয়ে গেলেও তার গ্রুপের হয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছেন তামিন ও সোহেল। সোহেল হলেন চঞ্চলের ভাগনে এবং মিল্কি হত্যার অন্যতম আসামি। ডালিম-রবিন-মাহাবুব গ্রুপের হয়ে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে মজিবুর রহমান ওরফে ছোটন।
পুলিশ আরও জানায়, গুদারাঘাট এলাকায় মেহেদী গ্রুপের এবং গুলশান ডিএনসিসি এলাকায় জিসান গ্রুপের আধিপত্য বেশি। সম্প্রতি ডিএনসিসি মার্কেটটি ভাঙার কাজ শুরু হয়। এই কাজটি পায় মেহেদী গ্রুপ। এলাকাটি জিসানের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মার্কেটের কাজ মেহেদী গ্রুপ পাওয়ায় দুগ্রুপের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করছে। দুই গ্রুপের বিরোধের বিষয়ে তদন্ত চালাতে গিয়ে পুলিশ মেহেদী ওরফে কলিংস গ্রুপের বেশ কয়েকজনের নাম পেয়েছে। তারা হলেন-বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের বড় সাঈদ, দক্ষিণ বাড্ডার দুলাল, ২১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মান্নান, একই ওয়ার্ডের ছাত্রলীগ সভাপতি ইমরান, ওই ওয়ার্ডের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ময়লা সাঈদ, আনন্দনগরের মালিক, দক্ষিণ বাড্ডার সজল, পোস্ট অফিস গলির পলক এবং অর্নব সাঈদ, আলাতুন্নেছা স্কুল রোডের রবিউল, কুমিল্লাপাড়া এলাকার কানি সোহেল, উত্তর বাড্ডার হেলার এবং পূর্ব বাড্ডার মবিনুল ইসলাম বাঁধন। সন্ত্রাসী গ্রুপের তিন সদস্য গ্রেফতারের পর তারা সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রাজন কুমার সাহা যুগান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসী এবং অপরধারী যেই হোক না কেন আমরা তাদের আইনের আওতায় আনব। শনিবার গ্রেফতারকৃত তিনজনের কাছ থেকে সন্ত্রাসী চক্রের বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ সবকিছুই করবে বলে এসি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইন্টারপোলের রেড নোটিশপ্রাপ্ত জিসান আহমেদ মন্টির জন্ম ১৯৭০ সালে। ২০০৩ সালের ১৪ মে রাজধানীর একটি হোটেলে দুজন ডিবি পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ২৩ জন কালো তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীর অন্যতম জিসান এখন দুবাইতে অবস্থান করছেন। ১৯৯৭ সালের দিকে জিসান ও তার ছোট ভাই শামীম রামপুরায় গার্মেন্টেসের ঝুট ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে জিসানের পরিচয় হয়। ওই সময় তিনি রামপুরার শাহজাদা গ্রুপের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন অপরাধ তৎপরতা চালাতেন। মতিঝিলের খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জিকে শামীমের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন জুয়ার আসর পরিচালনা করতেন। ২০০৩ সালের ১৪ মে রাতে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ১৫ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করতে যান জিসান। সেখানে তার বাহিনী পুলিশের ইন্সপেক্টর নুরুল আলম শিকদারসহ দুই পুলিশ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেন। ওই ঘটনার পরপরই জিসান আত্মগোপনে চলে যান।
