Logo
Logo
×

দ্বিতীয় সংস্করণ

শেয়ারবাজারে মার্জিন ঋণ নিয়ে টাস্কফোর্সের সুপারিশ

বিনিয়োগ ১০ লাখ টাকার কম হলে ঋণ নয়

Icon

মনির হোসেন

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শেয়ারবাজারে বহুল আলোচিত মার্জিন ঋণ (শেয়ার কেনায় ঋণ) নীতিমালায় স্বচ্ছতা আনা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সরকার গঠিত শেয়ারবাজারসংক্রান্ত টাস্কফোর্স। এর মধ্যে অন্যতম হলো-কোনো বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ (পোর্টফোলিওর মূল্য) ১০ লাখ টাকার কম হলে, তিনি মার্জিন ঋণ সুবিধা পাবেন না। ঋণ পেতে ওই বিনিয়োগকারীর কমপক্ষে ৬ মাসের অভিজ্ঞতা লাগবে। তবে উদ্যোক্তা শেয়ার কিনতে ঋণ মিলবে না। টাস্কফোর্সের সুপারিশ মঙ্গলবার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) জমা দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও টাস্কফোর্সের সদস্য আল-আমিন যুগান্তরকে বলেন, মার্জিন ঋণের ইস্যুটি শেয়ারবাজারে অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ফলে এই ঋণের নীতিমালায় সংস্কার আনতে আমরা বেশ কিছু সুপারিশ করেছি। এর মধ্যে কারও পোর্টফোলিও ১০ লাখ টাকার কম হলে, তিনি ঋণ পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন না। এছাড়া বর্তমানে এক এক প্রতিষ্ঠান ভিন্ন সুদ নেয়। কিন্তু এখানে আমরা সংস্কারের কথা বলেছি। অর্থাৎ ঋণের সুদ কত হবে, পরিষ্কারভাবে চুক্তিতে উল্লেখ করতে হবে। ‘এছাড়া আরও বেশ কিছু সুপারিশ রয়েছে। এই সুপারিশের ওপর সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত নীতিমালা করবে কমিশন।’

গ্রাহককে শেয়ার কিনতে মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউজ থেকে যে ঋণ দেওয়া হয়, তাকে মার্জিন ঋণ বলে। বর্তমানে মার্জিন ঋণের এই হার ১ঃ০.৮। এর অর্থ হলো কোনো গ্রাহকের ১০০ টাকা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজ থেকে আরও ৮০ টাকা ঋণ নেওয়া যাবে। তবে এই সীমা মানে না অনেক প্রতিষ্ঠান। কোনো কোনো সময় গ্রাহকের বিনিয়োগের বিপরীতে দশগুণ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছিল বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ। এর ফলে বাজারে ভয়াবহ নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়। ২০১০ সালেও মার্জিন ঋণের কারণে শেয়ারবাজারে বিপর্যয় হয়েছে।

টাস্কফোর্সের সুপারিশে বলা হয়, কোনো বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও ১০ লাখ টাকার কম হলে, তিনি শেয়ার কিনতে মার্জিন ঋণ পাবেন না। আবার যে বিনিয়োগকারী ঋণ নেবেন, বাজারে কমপক্ষে তার ৬ মাসের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অর্থাৎ বিও অ্যাকাউন্ট (শেয়ার লেনদেনের অ্যাকাউন্ট) খোলার পর ৬ মাসের আগে কোনো বিনিয়োগকারীকে ঋণ দেওয়া যাবে না। কারণ অনেক সময় বিনিয়োগকারীরা না বুঝে মার্জিন ঋণ নেয়। এরপর বাজারে লোকসান করে সর্বস্ব হারায়। কোন কোন শেয়ারে ঋণ দেওয়া যাবে, সুপারিশে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, কোনো ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে, কোম্পানির মূল্য আয়ের অনুপাত (পি/ই রেশিও) সর্বোচ্চ ২০ হলে, ওই কোম্পানির শেয়ার কেনায় ঋণ দেওয়া যাবে। এর বেশি হলে ঋণ মিলবে না। তবে অন্যান্য কোম্পানির ক্ষেত্রে এই সীমা ৩০। তবে কোনো কোম্পানির ‘আনরিয়ালাইজ গেইনের’ (শেয়ার বিক্রি করা হয়নি) বিপরীতে ঋণ দিতে পারবে না কোনো প্রতিষ্ঠান। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ৬ থেকে ১২ মাসের চুক্তি থাকবে। সেখানে সুদের স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। তবে কেউ উদ্যোক্তা বা স্পন্সর শেয়ার কিনতে চাইলে ওই শেয়ারে মার্জিন দেওয়া হবে। কারণ স্পন্সর শেয়ার সব সময় বিক্রি করা যায় না। ফলে ঋণের টাকা আটকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঋণের সুনির্দিষ্ট চুক্তি হবে গ্রাহক ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। সেখানে মার্জিন ঋণ আদায়ে মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজ ফোর্সড সেল (বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি) করতে চাইলে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

এদিকে আন্তর্জাতিকভাবেও মার্জিন নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। মার্জিন ঋণের ভয়াবহতা নিয়ে ২০১৭ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাজার উত্থান-পতনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হলো মার্জিন ঋণ। একই বিষয়ে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব মুয়েনস্টার। ওই প্রতিবেদনে মার্জিন ঋণকে বাজারের জন্য অভিশাপ হিসাবে দেখানো হয়। এতে বলা হয়, আর্থিকভাবে শক্তিশালী বিনিয়োগকারীরা মার্চেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে আঁতাত করে বেশি পরিমাণে ঋণ নেয়। ফলে তারা ইচ্ছেমতো দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে। আর বাজার ধীরে ধীরে অতিমূল্যায়িত হয়। এরপর বাজারে মূল্য সংশোধন হলে তুলনামূলকভাবে কম পুঁজির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুঁজিবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১১ সালে গঠিত স্কিম কমিটির হিসাবে দেখা গেছে, দেশের শেয়ারবাজারে মার্জিন ঋণ নিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন-এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৬ লাখ ৬৯ হাজার। তাদের মোট ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার ৭০ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যত দূর সম্ভব ঋণ না করেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত। কারণ যেসব বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়েছে, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রন্ত হয়েছে। কিন্তু ঋণের বাইরে থাকা বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি সম্পূর্ণভাবে হারায়নি। ফলে ঋণের ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকা উচিত। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে ঝুঁকি থাকবেই। ঋণ না করে সঞ্চিত অর্থ থেকে বিনিয়োগ করা ভালো। যারা মার্জিন ঋণ নেন, তারা লোভে পড়ে নেন। দরপতনে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্দা শেয়ারবাজারে গলার কাঁটা মার্জিন ঋণ। বর্তমানে বাজারে মার্জিন ঋণ ১৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। বিভিন্ন সময়ে বাজার অতিমূল্যায়িত হওয়ার ক্ষেত্রেও এই ঋণ দায়ী। কারণ মৌলভিত্তির বাইরে দুর্বল কোম্পানিতেও ঋণ নিয়ে কারসাজি হয়। এর আগে ২ বছর বাজারে ফ্লোর প্রাইস (নিুসীমা) ছিল। ওই সময়ে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করতে পারেনি। কিন্তু ঋণের সুদ বেড়েছে। ফলে যেসব বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করছেন, তারা সবচেয়ে বিপদে। সমস্যায় রয়েছে, ঋণ দেওয়া মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজগুলোও। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উভয় পক্ষকেই নিঃস্ব করছে মার্জিন ঋণ। সামগ্রিকভাবে বাজারের জন্যও বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

জানা গেছে, শেয়ারবাজারে লেনদেন করছে বর্তমানে এমন ব্রোকারেজ হাউজের সংখ্যা ২৪০টি। এর মধ্যে গ্রাহককে মার্জিন ঋণ দিয়েছে এমন হাউজের সংখ্যা ১০০টির মতো। মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সামগ্রিকভাবে ঋণের হার গ্রাহকের বিনিয়োগের ১৫ শতাংশের মতো। তবে মোট ঋণের ৬০ শতাংশই শীর্ষ দশটি হাউজে। অন্যদিকে ২০১০ সাল থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্জিন ঋণে বিনিয়োগকারীরা। ওই সময়ে ঋণ নিয়ে যারা বিনিয়োগ করেছিল, তাদের সব পুঁজি হারানোর পরও হাউজগুলো তাদের কাছে টাকা পাবে। সেই টাকার বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে নতুন ঋণ আরও বাড়ছে।

জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে লেনদেনযোগ্য বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১৭ লাখ ৫০ হাজার। এসব বিও অ্যাকাউন্টে মোট শেয়ার সংখ্যা ১০ হাজার ১৪১ কোটি। আর এসব শেয়ারের সর্বশেষ বাজারমূল্য ৩ লাখ ৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। যদিও বর্তমানে বাজারমূল্যের তুলনায় মার্জিন ঋণের মূল অঙ্ক অনেক কম। কিন্তু শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় সুদ ও আসল মিলিয়ে দিন দিন ঋণের অঙ্ক বাড়ছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম