Logo
Logo
×

দ্বিতীয় সংস্করণ

পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন থামছেই না

গাজীপুরে আট মাসে ৯০ বার মহাসড়ক অবরোধ

Icon

মোহাম্মদ মোরশেদ আলম, গাজীপুর

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গাজীপুরে বেতন-বোনাস বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন যেন থামছেই না। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেলায় আট মাসে অন্তত ৯০ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। কয়েক দিন পরপর এই অবরোধের কারণে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়ছেন এসব পথে চলাচলকারী হাজারো যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিক।

সবশেষ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের হোতাপাড়ায় ইউটা গার্মেন্টসের শ্রমিকরা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। ঈদের ছুটি ও বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে তারা। দেড় ঘণ্টা পর যৌথবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে ১৭ মার্চ সকালে মহানগরের ভোগড়ায় বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে মীম গার্মেন্টসের শ্রমিকরা। দুই ঘণ্টা পর পুলিশ ও সেনাসদস্যদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরও আগে রোববার নগরীর তেলিপাড়ায় ঈদ বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে স্মাগ সোয়েটার লিমিটেডের শ্রমিকরা। সকাল ৯টা থেকে টানা তিন ঘণ্টা অবরোধের পর সেনাবাহিনী ও পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের সরিয়ে দিলে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। ওই সময় আশপাশের ৫-৬টি কারখানা অনভিপ্রেত ঘটনা এড়াতে ছুটি ঘোষণা করে।

ওই সময় আন্দোলনরত শ্রমিক আলতাফ হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন মহাসড়ক আটকে রেখেছেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাগো দেশে যদি ভদ্রভাবে কোনো কথা কন তাইলে কেউ হোনব না। কথা হোনার মানুষও পাইবেন না। স্যারেগো বারবার কয়তাছি আমাগো সমস্যা সমাধান করেন। ঈদ বোনাস বাড়াইয়া দেন কিন্তু তারা কইতাছে দিব না। যার কারণে সড়ক বন্ধ কইরা আন্দোলন করতাছি। এহন সরকারের লোকজন আইবো তখন ঠিকই আমাগো সমস্যা সামাধান হইয়া যাইব।’

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআই’র সদস্য মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, শ্রমিকদের কোনো সমস্যা থাকলে তারা বিজিএমইএতে যেতে পারে। সেখানে সবার কথা বলার একটা জায়গা আছে। তারা সেখানে আলোচনা না করে যখন-তখন সড়ক মহাসড়ক বন্ধ করে আন্দোলন করলে মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এই শিল্পকে ধ্বংস করতে নানা ধরনের চক্রান্ত হচ্ছে। সেজন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কথায় কথায় রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন থেকে বিরত থাকতে হবে।

জানা গেছে, গত আট মাসে অন্তত ৯০ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবরোধ হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে ২১ বার। এছাড়া আগস্টে ৭ বার, সেপ্টেম্বরে ১৮ বার, অক্টোবরে ১২ বার, ডিসেম্বরে ৮ বার এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫ বার, ফেব্রুয়ারিতে ১১ বার ও মার্চে ৮ বার মহাসড়ক অবরোধ করেন শ্রমিকরা। এছাড়াও অনেক স্থানে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। তবে সেগুলো কারখানা এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময়ে জেলায় অন্তত শতাধিক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে বলে শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন করেছে মহানগরীর জিরানী সারাবো এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকরা। গত ১৬ ডিসেম্বর ওই পার্কের ১৬টি কারখানা একযোগে বন্ধ (লে-অফ) ঘোষণা করা হয়। পরদিন থেকে প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক টানা ৬ দিন অবরোধ করে রাখেন। পরে বেতন পেয়ে শ্রমিকরা মহাসড়ক থেকে সরে যান।

শিল্প পুলিশ ও কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কালিয়াকৈরে মৌচাক এলাকার গ্লোবাস অ্যাপারেলস লিমিটেড ও আগামী ওয়াশিং লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বেতনভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেন। বেতনের দাবিতে টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিএইচআইএস অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিকরা। জিরানী এলাকার রেডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল ও আইরিশ ফ্যাশন কারখানার শ্রমিকেরা হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল ও নাইট বিল বৃদ্ধির দাবিতে অন্তত চার দিন চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এসব এলাকায় শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপে কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবিদাওয়া মেনে নিলে পরিবেশ শান্ত হয়।

অপর দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন কোনাবাড়ী ইসলাম গার্মেন্টস লিমিটেড, রেজাউল অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফ্যাশন সুমিট লিমিটেড, কেএম নোভেলি লিমিটেড, স্বাধীন ফ্যাশন, ফ্যাশন পয়েন্ট, লাইফট্যাক্স লিমিটেড, কানিজ ফ্যাশন, এবিএম ফ্যাশন লিমিটেড, পিএন কম্পোজিট, মুকুল নিটওয়্যার, কটন ক্লাব, এ্যামা সিনট্যাক্স, বেসিক ক্লোথিং ও অ্যাপারেল প্লাসের শ্রমিকেরা। চন্দ্রা এলাকায় মাহমুদ জিনস ও নূরুল স্পিনিং কারখানার শ্রমিকেরাও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এ ছাড়া পানিশাইল এলাকার ডরিন ফ্যাশন, চন্দ্রা এলাকার মাহমুদ জিনসের শ্রমিকেরা নানা দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন। অবরোধের কারণে প্রায়ই দুর্ভোগে পড়ছেন গাজীপুরের ভিআইপি পরিবহণের চালক কবির হোসেন। তিনি বলেন, পোশাক শ্রমিকরা যদি আন্দোলন করে সড়ক অবরোধ ও যানবাহন ভাংচুর করে তবে এখন থেকে পরিবহণ শ্রমিকরাও আন্দোলন করবে। কারখানা শ্রমিকদের প্রতিহত করা হবে। তারাও শ্রমিক আমরাও শ্রমিক। তাদের দাবি থাকলে কারখানায় আন্দোলন করবে আমাদের রাস্তায় কেন আসবে। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, সাধারণ শ্রমিকরা মনে করে বিজিএমইএসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘুরে তারা দ্রুত সমস্যার সমাধান পাবে না। যার কারণে তারা হুটহাট রাস্তা বন্ধ করে অবরোধ করছে। তারা মনে করে রাস্তা অবরোধ করলে প্রশাসন আসবে এবং দ্রুত তাদের সমস্যার সমাধান করে দেবে। এটা বন্ধ করতে হলে প্রতিটি কারখানা শ্রমিকদের সংগঠন করতে হবে।

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, রাস্তা অবরোধ ছাড়া আর কোনো বিকল্প তাদের কাছে নেই যাতে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যাবে। সড়কে ভোগান্তি সৃষ্টি হলে পুলিশ, কলকারখানা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। এভাবে অনেক সময় তারা প্রত্যাশিত সমাধান পাচ্ছেও।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম