ওসির নেতৃত্বে বাসায় ঢুকে ভাঙচুরের অভিযোগ
এক কোটি টাকা না দিলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি
কলাবাগান থানার ওসিসহ দুই এসআই বরখাস্ত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে গভীর রাতে রাজধানীর কলাবাগানে একটি বাসার দরজা ভেঙে প্রবেশ করেন পুলিশের দুই এসআই। তাদের সঙ্গে ছিল স্থানীয় কিছু ব্যক্তিও। তিনতলা ভবনটির উপরের তলার ফ্ল্যাটের মূল ফটক ভেঙে প্রবেশ করেই বলতে থাকেন-অস্ত্র কোথায়, অস্ত্র কোথায়; শুরু করেন ভাঙচুর, লুটপাট। এ সময় ওই ভবনের নিচে অবস্থান করছিলেন কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তারুজ্জামান। এমন পরিস্থিতিতে হতভম্ব হয়ে পড়েন বাসার বাসিন্দা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট ড. আব্দুল ওয়াদুদ। ফ্ল্যাটে প্রবেশ করা এসআই মান্নান একপর্যায়ে আব্দুল ওয়াদুদকে ডেকে বলেন, এক কোটি টাকা দিতে হবে। তা না হলে মামলায় ফাঁসানো হবে। ড. আব্দুল ওয়াদুদ তখনো জানেন না তার অপরাধ কী। ভয়ে বাসায় থাকা দুই লাখ টাকা দিয়ে বাকিটা পরদিন সকালে ব্যাংক থেকে তুলে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন ওই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। পরে বাড়ির বাইরে পাহারা বসিয়ে চলে যায় পুলিশ। পরদিন ব্যাংক থেকে টাকা তোলার কথা বলে বাসা থেকে কৌশলে পালিয়ে যান আব্দুল ওয়াদুদ।
রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন ২২/২ নম্বর বাসায় ২৯ এপ্রিল রাতে ঘটে ভয়ংকর এ ঘটনা। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারসহ সরকারের ঊর্ধ্বতনদের কাছে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী আব্দুল ওয়াদুদ। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মেলায় কলাবাগান থানার ওসি মোক্তারুজ্জামান, দুই উপপরিদর্শক (এসআই) বেলাল ও মান্নানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সোমবার ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনিক কারণে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। এদিকে ওই ঘটনার সঙ্গে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কোনো সদস্য ছিলেন না বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন ডিবির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা।
ড. আব্দুল ওয়াদুদ যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে আমার বাসায় ডাকাতি করেছে। আমি পশুপাখি পালি, বাসায় হরিণ পালি, এজন্য তারা ভেবেছে আমি অনেক টাকাপয়সার মালিক। তিনি আরও বলেন, আমার সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ নেই। থানায় কোনো মামলা নেই। ঢাকার ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজসহ আরও অনেক জায়গায় পড়িয়েছি। ২০১৬ সালে অবসরে চলে গেছি। এরপর থেকে পত্রিকায় কলাম লেখি। আমার ১২০০-এর ওপরে কলাম ছাপা হয়েছে।
ডিএমপির রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ডিএমপির সদর দপ্তর। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়, পরে দুই এসআইকে প্রত্যাহার করে রমনা বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। ডিএমপি থেকে তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনারের কাছে করা লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ড. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ২৯ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বেলালের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সদস্য ও ১৫/২০ জনের একদল সন্ত্রাসী আমার বাড়িতে জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে। আমার ম্যানেজার ৯৯৯-এ কল করলে এক গাড়ি পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহবাগ ও নিউমার্কেট থানার টহল টিমের দুটি গাড়ি এসে বাড়িসংলগ্ন প্রধান রাস্তায় থামে। ম্যানেজার দেখতে পান কলাবাগান থানার ওসি মোক্তারুজ্জামান নিউমার্কেট ও শাহবাগের টহল টিমকে চলে যেতে বলছে। শাহবাগ ও নিউমার্কেট থানার টহল টিমকে সংবাদ দেওয়ার জন্য আমার ষাটোর্ধ্ব ভাড়াটিয়া লাল মিয়া ও নাইটগার্ড লুৎফরকে কলাবাগান থানার ওসি পুলিশের গাড়িতে তুলতে নির্দেশ দেন, যা আমার বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ রয়েছে। অভিযোগে আরও বলা হয়, বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়া এসআই বেলালের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সদস্য তৃতীয় তালার দরজা ভাঙার চেষ্টা করে। গভীর রাতে সন্ত্রাসী তাণ্ডব ও দরজা ভাঙার শব্দে আশপাশের লোকজনদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। আমার ৯০ বছরের বৃদ্ধ মা ও স্ত্রী আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
একটি দরজা ভাঙার পর দ্বিতীয় দরজা যখন ভাঙার চেষ্টা চলছিল, তখন আমি কলাবাগান থানার ওসিকে সাহায্যের জন্য মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে বাড়ি থেকে পুলিশের সঙ্গে বের হয়ে আসতে বলেন। ডিবির লোক এসেছে, তাদের সহযোগিতা করতে বলেন।
কোনো উপায়ান্ত না দেখে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমি পুলিশের সঙ্গে থানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং দরজা খুলে দিই। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে এসআই বেলাল ও মান্নান আমাকে ধাক্কা মেরে আবার ঘরের ভেতরে টেনে নেয় এবং উগ্রভাবে আমার কাছে কী কী অস্ত্র আছে, তা জানতে চায়। তারা বাসার মধ্যে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেন এবং কী যেন খুঁজতে থাকেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, যাওয়ার সময় এসআই বেলাল বাড়িতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি-এরকম একটা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি জোরপূর্বক আমার কাছ থেকে আদায় করে ভিডিও ধারণ করে।
বাড়িসংলগ্ন আমার মিনি চিড়িয়াখানায় সরকারি লাইসেন্স নিয়ে হরিণ পালন করে আসছি ২০০৬ সাল থেকে। নিচে নেমে দেখতে পাই হরিণগুলোর মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। গভীর রাতে দরজা ভাঙার উচ্চ শব্দে হরিণ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একটি গর্ভবতী হরিণ ওইদিন দুপুরে মারা যায়। মিনি চিড়িয়াখানার ম্যাকাও, কাকাতুয়া, ইলেকট্রিক, রেইনবো লরিসহ বিদেশি দুর্লভ ও মূল্যবান পাখিগুলো লুট হয়ে যায়। পুলিশ কম্পিউটারের পিসি, ল্যাপটপ, সিসি ক্যামেরার হার্ডডিক্স নিয়ে যায়।
লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ড. ওয়াদুদ বলেন, এখনো সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের ভয়ে বাসায় যেতে পারছি না। টাকা না পেয়ে চাঁদাবাজদের হুমকি-ধমকি চলমান আছে। অপরিচিত লোকজন বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। আমি নিরাপত্তাহীনতা ও জীবনের শঙ্কায় ভুগছি।
