Logo
Logo
×

দ্বিতীয় সংস্করণ

বিশ্ব উচ্চরক্তচাপ দিবস আজ

প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতি ৪ জনে একজন উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন

বাড়ছে হৃদরোগ স্ট্রোক, কিডনি রোগ ও মৃত্যুঝুঁকি

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উচ্চরক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক ব্যাধি, যা হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি বিকলসহ নানা জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। তবে দেশে উচ্চরক্তচাপ আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসা গ্রহণের হার মাত্র ৩৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৩৪ শতাংশ এবং নারী ৪২ শতাংশ। নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে মাত্র ১৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজন। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের অর্ধেক মানুষ জানেই না যে তার রোগটি আছে।

এমন বাস্তবতায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব উচ্চরক্তচাপ দিবস-২০২৫। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আপনার রক্তচাপ সঠিকভাবে পরিমাপ করুন, এটি নিয়ন্ত্রণ করুন, দীর্ঘজীবী হোন।’ প্রতিপাদ্যে নিয়মিত এবং সঠিক রক্তচাপ পরিমাপের গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসকদের মতে, হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে রক্তপ্রবাহের চাপ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাডপ্রেশার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। দুটি মানের মাধ্যমে এই রক্তচাপ রেকর্ড করা হয়। যেটার সংখ্যা বেশি সেটাকে বলা হয় সিস্টোলিক প্রেশার, আর যেটার সংখ্যা কম, সেটা ডায়াস্টলিক প্রেশার।

প্রতিটি হৃদস্পন্দন, অর্থাৎ হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও সম্প্র্রসারণের সময় একবার সিস্টোলিক প্রেশার এবং একবার ডায়াস্টলিক প্রেশার হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। কারও ব্লাডপ্রেশার রিডিং যদি ১৪০/৯০ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে। অন্যদিকে রক্তচাপ যদি ৯০/৬০ বা এর আশপাশে থাকে, তাহলে তাকে লো ব্লাড প্রেশার হিসাবে ধরা হয়। যদিও বয়স-নির্বিশেষে রক্তচাপ খানিকটা বেশি বা কম হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলছেন, বাংলাদেশে উচ্চরক্তচাপ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। দেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি উচ্চরক্তচাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও)-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে উচ্চরক্তচাপে আক্রান্তদের বয়স ৩০-৭৯ বছর যার অর্ধেকই (৫৫ শতাংশ পুরুষ, ৪৬ শতাংশ নারী) জানে না যে তাদের রোগটি রয়েছে। ডব্লিউএইচওর গ্লোবাল রিপোর্ট অন হাইপারটেনশন-২০২৩ তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করেছে, যার ৫৪ শতাংশের জন্য দায়ী উচ্চরক্তচাপ।

গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে অঞ্চল, বয়স, শিক্ষা এবং লিঙ্গভেদে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপের পার্থক্য আছে। ফলে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে প্রতিকার এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। কিন্তু এটি মোকাবিলায় অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো অপরিহার্য হয়ে পড়ছে বলে উল্লেখ করেছেন গবেষকরা। জনস্বাস্থ্যবিদরা যুগান্তরকে বলছেন, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু খাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০২৫) রয়েছে। যেখানে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুসরণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে ২৫ শতাংশ কমানোর জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উচ্চরক্তচাপ ব্যবস্থাপনায় জাতীয় গাইডলাইন এবং এর চিকিৎসায় ন্যাশনাল প্রটোকল প্রণয়ন করা হয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি (২০১৭-২০২২) হেলথ, পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন সেক্টর প্রোগ্রাম (চতুর্থ এইচপিএনএসপি)-এ অসংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনায় উচ্চ রক্তচাপকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এরপরও উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা গ্রহণের হার মাত্র ৩৮ শতাংশ। নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন ১৫ শতাংশ রোগী। তৃণমূল পর্যায়ে বিনামূল্যে এ রোগের ওষুধ প্রদানের কাজ শুরু হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কেন সম্ভব হচ্ছে না সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ‘রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, উচ্চরক্তচাপের কোনো উপসর্গ নেই। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে উচ্চরক্তচাপ পরিমাপ না করলে পরিস্থিতি বোঝা যায় না। অনেকে স্ক্রিনিং করলেও চিকিৎসকের কাছে যাওয়া বা নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন না। দেশে নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা ও রোগীদের রেফারেল সিস্টেম উন্নতি হয়নি। উপজেলা হাসপাতাল বা চিকিৎসকের চেম্বারে গেলে স্ক্রিনিং করা হয়। মূলত অসচেতনতা ও অনিয়মিত ওষুধ সেবনে উচ্চরক্তচাপে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি দেখা দিচ্ছে। অকাল মৃত্যুর হার বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে রক্তচাপ পরিমাপের বিষয়ে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবস্থা থাকতে হবে। কর্মক্ষেত্র ও শিল্পাঞ্চলে বছরে অন্তত একবার উচ্চরক্তচাপ পরিমাপ ও প্রাইমারি কেয়ারের আওতা সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ প্রদানের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ারের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (পিএম) ডা. গীতা রানী দেবী যুগান্তরকে বলেন, উচ্চরক্তচাপের প্রকোপ মোকাবিলায় সরকারিভাবে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ তালিকায় উচ্চরক্তচাপের (এমলোডিপিন ৫ মিলিগ্রাম) ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেসব উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স (নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ) এনসিডি কর্নার চালু আছে সেসব উপজেলার আওতাভুক্ত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে উচ্চরক্তচাপের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এনসিডি কর্নারের মাধ্যমে গত অর্থবছর প্রায় ১০ হাজার কমিউিনিটি ক্লিনিকে ওষুধ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরে সারা দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধ ক্রয়ের প্রস্তুতি চলছে। জুনের মধ্যেই ওষুধগুলো সরবরাহ করার কার্যক্রম চলছে। বিশ্ব উচ্চরক্তচাপ দিবস উপলক্ষ্যে রোগটি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে শনিবার সকাল সাড়ে ৬টায় মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল পর্যন্ত একটি সচেতনতামূলক র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ৯টায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে একটি গণমুখী সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম