হাজারীবাগে দুই হত্যাকাণ্ড
মাদকে আলভী ও ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে নুরকে খুন
আতঙ্কিত এলাকাবাসী নিরাপত্তা জোরদারের আহ্বান
আবদুল্লাহ আল মামুন ও জহিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানীর হাজারীবাগ থানাধীন এলাকায় আধ ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর মধ্যে মাদক কারবারকে কেন্দ্র করে পূর্বশত্রুতার জেরে জিগাতলায় সামিউর রহমান আলভী (২৭) ও ভিডিও ক্যামেরা ছিনতাইয়ের জন্য পরিকল্পিতভাবে শংকরের ফটোগ্রাফার নুর ইসলাম ফকিরকে (২৪) হত্যা করা হয়। দুই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করছে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতোমধ্যে ভুক্তভোগী দুই পরিবার থানায় মামলা করেছে।
মোহাম্মদপুর ও হাজারীবাগসহ আশপাশের এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হতেই এলাকাবাসী ভয় পাচ্ছেন। মূলত বিভিন্ন কিশোর গ্যাং এসব ঘটনায় জড়িত থাকলেও তাদের নির্মূলে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না বলে তারা অভিযোগ করছেন।
আলভী হত্যার নেপথ্যে মাদক কারবার : বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে হাজারীবাগ থানাধীন জিগাতলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন সামিউর রহমান আলভী। এ ঘটনায় তার চার বন্ধু ইসমাইল, জাকারিয়া, দৃশ্য ও আশরাফুল আহত হয়েছেন। হাজারীবাগ থানা পুলিশ বলছে, জিগাতলায় আড্ডা দেওয়ার সময় আলভী ও তার সঙ্গীদের ওপর ছুরি নিয়ে হামলা চালায় একটি পক্ষ। এতে আলভী নিহত হন। তার সঙ্গে থাকা অন্যরা আহত হন।
আলভীর মামি মাহি বেগম জানান, আলভী গুলিস্তানে এক বন্ধুর ট্রাউজারের দোকানে চাকরি করত। কারা কেন তাকে মেরেছে সেটি তিনি বলতে পারেন না।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন অভিযোগ করেন, শংকর এলাকার মাদক কারবারি ও কিশোর গ্যাং লিডার শুভর নেতৃত্বে ইয়াসিন, নিলয়সহ ২০-৩০ জন ধানমন্ডি বাগানবাড়ির ৮ নাম্বার ও আশপাশের এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে মাদক সেবন ও কেনাবেচা করছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে প্রথমে আশরাফুল ওই গ্যাংয়ের সদস্যদের সেখানে মাদক সেবন করতে নিষেধ করেন। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে একজনকে চড় মারেন আশরাফুল। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলভীর এক বন্ধু জানায়, আগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার রাতে জিগাতলা ইবনে সিনা হাসপাতালসংলগ্ন নেসক্যাফে কফির দোকানের সামনে শুভর সহযোগীরা আলভীর বন্ধু জাকারিয়াকে ব্যাপক মারধর করে। পরে জাকারিয়ার কাছ থেকে আলভীসহ বাকিদের ঠিকানা নিয়ে জিগাতলা দারোগা মার্কেটের গলিতে গিয়ে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, শংকর ও মধুবাজার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে শুভর নেতৃত্বে ইয়াসিন, নিলয়সহ ২০-৩০ জনের একটি সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী চক্র তৎপর। তারা এলাকায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত এবং ভীতি ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কে রাখে। সম্প্রতি এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে এক ব্যবসায়ীর ওপর হামলার ঘটনায়ও শুভ সরাসরি জড়িত ছিল বলে জানা গেছে।
ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আলভীদের সঙ্গে প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপের দ্বন্দ্ব হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত হোক, দ্রুত শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হবে।
ক্যামেরা ছিনতাইয়ে নুরকে পরিকল্পিত খুন : পুলিশ ও স্বজনরা বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে হাজারীবাগ থানাধীন রায়েরবাজার দুর্গা মন্দিরের গলিতে খুন হন নুর ইসলাম। তার সঙ্গে থাকা বন্ধু ইমন বলেন, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ক্যামেরা ভাড়া নেওয়ার কথা বলে তাদের শংকর আসতে বলা হয়েছিল।
তারা শংকর পৌঁছালে রিকশায় করে সামনে যেতে বলে। এর মধ্যে তারা রিকশায় উঠে কিছুদূর গেলেই চার-পাঁচজন রিকশা ঘিরে ফেলে। তাদের সবার হাতে ছুরিসহ ধারালো অস্ত্র ছিল। তারা ধর ধর বলে আমাদের ওপর আক্রমণ করে। এর মধ্যে নুর ইসলাম সামনে ও আমি পেছনের দিকে দৌড় দেই। ওরা পেছনের দিকে ধাওয়া করে নুর ইসলামকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। পরে সঙ্গে থাকা দুটি মোবাইল ফোন ও দুটি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে যায়।
ইমন আরও বলেন, আমার ক্যামেরার দাম তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা হবে। নুরের ক্যামেরা দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। তারা ক্যামেরা ভাড়া নেওয়ার কথা বলে মূলত ছিনতাই করতে আমাদের ডেকেছিল। আমি আগেই ক্যামেরা দিয়ে পেছনে দৌড় দেওয়ায় বেঁচে যাই। নয়তো ওরা আমাকেও মেরে ফেলত।
হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দুটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। আলভীর ঘটনায় তার বাবা ও নুরের ঘটনায় তার ভাই বাদী হয়ে মামলা করেছেন। একটি ঘটনায় পূর্বশত্রুতা ও অন্যটি পরিকল্পিত ছিনতাই বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা সম্ভাব্য সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করছি। ময়নাতদন্ত শেষে দুজনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
হাজারীবাগের মুদি দোকানি রুহুল আমিন বলেন, কয়েক দিন পর ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনের ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের টনক নড়ছে না।
এলাকাবাসী সব সময় আতঙ্কে থাকছেন। সন্ধ্যার পর কেউ বের হতে সাহস পান না। নিরাপত্তা জোরদারে তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, দুটি ঘটনায় অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে পুলিশ। কী কারণে, কেন হত্যার ঘটনা ঘটেছে, পেছনে কারা ছিলেন-সেটি তদন্ত করা হচ্ছে।
