Logo
Logo
×

দ্বিতীয় সংস্করণ

ফ্রান্সে বাংলাদেশি পরিচয়ে ভারতীয়দের জালিয়াতি

ভুয়া তথ্য দিয়ে নিচ্ছেন মানবিক আশ্রয়, ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি

Icon

সরদার হাসান ইলিয়াছ তানিম, প্যারিস (ফ্রান্স)

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে নিজেদের বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিচ্ছেন কতিপয় ভারতীয়। তাদের এমন জালিয়াতির কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। ভুয়া নথিপত্র ও সাজানো পরিচয়ে তারা নিজেদের রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার বলে উপস্থাপন করে মানবিক আশ্রয় দাবি করছেন। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপিত হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু আইনি নয়, মানবিক ও কূটনৈতিক দিক থেকেও উদ্বেগজনক বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

ন্যাশনাল কোর্ট অব অ্যাসাইলাম (সিএনডিএ) ও ফরাসি গণমাধ্যম লো মন্ডের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার বাসিন্দা বিষ্ণজিৎ দাস ও তার স্ত্রী রিংকু দাস ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন বাংলাদেশি পরিচয়ে। তারা একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে ভুয়া জন্মসনদ, নাগরিক সনদ ও অন্য নথিপত্র সংগ্রহ করে প্যারিসে পাড়ি জমান। ফ্রান্স অফিস ফর দ্য প্রটেকশন অব স্টেটলেস রিফিউজিস (ওএফপিআরএ) আশ্রয় মঞ্জুর করে। ৫ বছর পর, ২০২২ সালের জুলাইয়ে তারা দিল্লি বিমানবন্দরে নামলে তাদের কাছে ভারতীয় পরিচয়পত্র ও ফরাসি আশ্রয়প্রাপ্ত হওয়ার কাগজপত্র পাওয়া যায়। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রেফতার করে এবং ফৌজদারি আইনে মামলা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়ন ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অভিযোগ তুললে ইউরোপে আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ তুলনামূলক সহজ। এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে ভারতীয় কিছু দালাল চক্র। তারা অর্থের বিনিময়ে ভুয়া বাংলাদেশি নথিপত্র সরবরাহ করছে। এই প্রবণতা মূলত সীমান্তবর্তী জেলা যেমন মালদা, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া থেকে শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে এসব দালাল চক্র ফরাসি ভাষায় অনুবাদসহ কাগজপত্র প্রস্তুত করে দেয়।

এছাড়া ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে একটি চার্টার ফ্লাইট দুবাই থেকে নিকারাগুয়া যাওয়ার পথে ফ্রান্সের ভাত্রি বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। বিমানে থাকা তিনশর বেশি যাত্রীর মধ্যে ২৫ জন ভারতীয় নাগরিক ফ্রান্সে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তাদের অনেকেই নিজেদের বাংলাদেশের বাসিন্দা বলে দাবি করেন। ফরাসি আদালতে সময়মতো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে না পারায় তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। বর্তমানে তারা ফ্রান্সে অনিয়মিতভাবে অবস্থান করছেন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিশ্লেষক ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ফ্রান্সের রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর, সামান্থা ভার বলেন, এটি শুধু একটি আইনি নয়, নৈতিক সংকটও বটে। দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকলেও, মিথ্যা পরিচয়ে আশ্রয় নেওয়া বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে তোলে।

ফরাসি অভিবাসন আইনজীবী বাহায়ি আগাঁহী আলাঁউই বলেন, জাল পরিচয় ও নথিপত্রের মাধ্যমে আশ্রয় লাভ শুধু আইন লঙ্ঘন নয়, ফ্রান্সের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নীতির ওপরও আঘাত। আমাদের সিস্টেমে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে আইনি সংস্কার জরুরি।

ফ্রান্স-বাংলাদেশ কালচারাল কমিউনিটির সভাপতি আসিফ ইকবাল বলেন, ফ্রান্সে বহু বাংলাদেশি বৈধভাবে কাজ ও পড়াশোনা করছেন। এই ধরনের প্রতারণার ফলে আমাদের পরিচয়ই সন্দেহের মুখে পড়ছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ফ্রান্সের নিস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক ম্যারি পিয়েখ বলেন, এই সমস্যা একক কোনো দেশের নয়। ভারত-বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে অভিবাসনসংক্রান্ত ত্রিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান জরুরি। অভিবাসনের নামে এই প্রতারণা একটি নীরব মানবিক সংকট তৈরি করছে। শুধু আইন নয়, সামাজিক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমেও এটি মোকাবিলা করতে হবে।

ফ্রান্সে বাংলাদেশি পরিচয়ে ভারতীয়দের আশ্রয় গ্রহণের প্রবণতা আন্তর্জাতিক অভিবাসন ব্যবস্থার জন্য এক গভীর সংকেত। এটি আইন, মানবিকতা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক-সব ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজন সচেতনতা, কঠোর আইন ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমন্বয়।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম