‘কেমন বাজেট চাই’ অনুষ্ঠানে ড. দেবপ্রিয়
সরকার বদল হলেও প্রক্রিয়া তো বদল হলো না
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বর্তমান সরকারের সময়ে এতগুলো সংস্কারের কর্মসূচি হয়েছে, এত সংস্কারের পথরেখা চান, নির্বাচনের পথরেখা চায়, বিচারের পথরেখা চায়। আমি জিজ্ঞেস করি, আমার অর্থনীতির পথরেখা কোথায়?’ ‘সরকার বদল হলেও প্রক্রিয়া তো বদল হলো না। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এনটিভি ও এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘কেমন বাজেট চাই’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আলোচনায় আরও অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী, এফবিসিসিআই’র প্রশাসক হাফিজুর রহমান, বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান। ড. দেবপ্রিয় বলেন, বিশ্বব্যাংক বলেছে এই সরকারের সময়ে ২৭ লাখ নতুন দরিদ্র হবে। এর মধ্যে ১৮ লাখ নারী। আর আপনারা বৈষম্যবিরোধী শেখাচ্ছেন নতুন সরকার? ‘আমি ড. মঈন খানের কথা থেকে বলি। আমি আগে তো বলেছি, তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই সরকার এসেছিল। তা হলো-ভিত্তিভূমিকে নির্দিষ্ট করা, স্থিতিশীলতাকে ফিরে নিয়ে আসা এবং সংস্কারের যে প্রতিবন্ধকতা আছে, তা সংস্কারের মাধ্যমে চিহ্নিত করা। কিন্তু এখানে যা ঘটেছে তা প্রত্যাশার অংশ ছিল না। তিনি বলেন, ‘ড. মঈন খান বললেন, আলাপ-আলোচনা কতটুকু সীমিতভাবে হয়েছে। আমি তার দুটি উদাহরণ আপনাদের বলি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয় এখানে বসা আছেন এবং কমিটির প্রধান আছেন, তারা কাজ করেছেন। আমার শ্বেতপত্রেও বলা আছে, রাজস্ব বোর্ডকে দুই ভাগ করা হোক। যারা কর আহরণ করে এবং যারা করনীতি করে দুজনকে একসঙ্গে রাখা উচিত নয়। এখানে স্বার্থের সংঘাত হবে। একটি ঠিক কাজ আলাপ আলোচনা ব্যতিরেকে যে কমিটি রিকমান্ড করেছিল তা পরিপালন না করে, যদি আপনি বাস্তবায়ন করতে চান, আপনার যে দুঃখজনক পরিণতি হয়েছে, তা-ই হওয়ার কথা। ঠিক কাজও যদি সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে করেন, তাহলে এমন পরিণতিই হবে।’ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমি আরেকটি উদাহরণ দেই, এই যে স্টক মার্কেটের জীর্ণদশা। এটা আসলেই মৃত প্রায়। ওটা আইসিইউর ভেতরে। ছিল ২৭ শতাংশ, কিন্তু এখনো জিডিপির ক্যাপিটাল ভ্যালু হিসেবে আছে ৮-৯ শতাংশ। এটাকে চালু করার জন্য যে সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, তাহলে স্টক মার্কেটে যারা অংশীদার রয়েছেন, তাদের সঙ্গে যদি আলোচনা না করে সিকিউরিটি অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন একা করতে যায়, তাহলে কোনো দিনই সম্ভব নয়। মানুষের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে ঠিক কাজও বেঠিক হয়ে যায়, যদি আলাপ আলোচনা উন্মুক্ত না থাকে। এটা আমার প্রথম বক্তব্য আপনার কাছে। আলাপ-আলোচনা করতে হবে এবং সবাইকে সুযোগ দিতে হবে। কী পরিবর্তন করলাম একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর থেকে।’
সিপিডির এই সম্মাননীয় ফেলো বলেন, ‘আমার দ্বিতীয় বক্তব্য আপনাদের কাছে, ড. আনিসুজ্জামান আছেন এখানে, সেটা হলো অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটের বিষয়ে বলেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট কী? যে বাজেট নিয়ে কাজ করছেন সেটা পতিত সরকারের বাজেট। পতিত সরকারের বাজেট নিয়ে আপনি প্রথমে সংশোধন করেছেন জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের দিকে এসে। কিন্তু কাঠামোগত কী উন্নয়ন করলেন? এখানে কাকে ছাড় দিচ্ছেন, কাকে ভর্তুকিতে রাখছেন? ইন্টারেস্ট রেট কোথায় দিচ্ছেন? কে বলতে পারবে আপনি কী স্বচ্ছতা দিয়েছেন আমাকে। ওই স্বৈরাচারী সরকারের আমলে যে স্বচ্ছতার অভাব দেখেছি, সবাইকে থামিয়ে দিয়েছে। এখনো কাজটা আপনারা একই রকম করলেন। আপনারা কোনো স্বচ্ছতা দিলেন না।’ তিনি বলেন, ‘ওই পতিত সরকারের যে এডিপি ছিল, ওই এডিপি থেকে কেমন করে কমানো হলো। ওই মেগা প্রজেক্টগুলো যে অতিমূল্যায়িত ছিল, কোথায় টাকা কমিয়েছেন। আমি তো আবার মেগা প্রজেক্টে বরাদ্দ দিতে দেখছি। আপনি ওখানে কীভাবে সামাজিক সংস্কারের অংশ হিসাবে কীভাবে নতুন প্রকল্প স্থান দিলেন, কোনো নীতিমালা হলো না। এখন সেই আগের এডিপি এখন চলছে। আমি সেটার ভিত্তিতে কাজ করছি।’ ‘আমি আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি, যে বাজেট করতে যাচ্ছেন এই সরকার তো নিঃসন্দেহে বৈধ সরকার, তবে নির্বাচিত সরকার তো না। তার তো নিঃসন্দেহে সীমাবদ্ধতা থাকবে। এই সরকার তো পুরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবে না। যদি আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে ফলো করি, তাহলে যারা পরবর্তী বাজেটে আসবে তারা যে এটার ধারাবাহিকতা রাখবে, এটার নিশ্চয়তা কীভাবে রাখব। এত বড় একটা ইনভেস্টমেন্ট সামিট হয়ে গেছে। রাতের বেলা সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, তোমাদের নীতি কাঠামো কোথায়? আমি তো বলতে পারি নাই। তারা বিনিয়োগ কি ৬ মাসের জন্য করবে, নাকি ৬ বছরের জন্য করবে এর তো ভবিষ্যতের বিশ্বাস থাকতে হবে। সেটি তো নেই। বাজেটে শুধু আয় ব্যয়ের কথা হয়েছে। এই আলোচনায় তো আমি সন্তুষ্ট নই। জুলাই বিপ্লবের যে আকাক্সক্ষা সেই তরুণদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে তো বাজেটে কিছু নেই। কোনো আলোচনা দেখছি না। এখন যেসব আলোচনা হচ্ছে এগুলো দুই বছর আগে হলেও একই আলোচনা শুনতে হতো। নতুন কিছু তো দিতে পারলেন না।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, এই সরকারের বিদেশি পরামর্শকদের প্রতি ভালোবাসা যতখানি আছে, ততখানি অন্য কোনো সরকারের ছিল বলে আমার মনে হয় না। এখন পুঁজিবাজার ঠিক করার জন্য বিদেশি কনসালটেন্ট আনতে বলে দেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে দেশে কেউ কিছুই জানে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, সাধারণ মানুষ অর্থনীতির প্যারামিটার বুঝে না। বাজেট এই সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রার মান কতটা উন্নয়ন করতে পারে, তাদের জীবনকে কতটুকু সহজ করতে পারে, সেটা দেখার বিষয়। কাজেই বাজেট প্রণয়নের সময় জনগণের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। তিনি আরও বলেন, আমি প্রথাগত অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একদিকে আইএমএফের সমালোচনা করছি, অন্যদিকে ঋণের জন্য তাদের পিছনে ঘুরছি। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক টেক্সট বুক সলিউশনের জন্য খুব ভালো। কিন্তু তারা বাংলাদেশকে পরামর্শ যেটা দিচ্ছে, সেটা বাংলাদেশের বেলায় প্রযোজ্য নয়। কারণ বাংলাদেশের ৭০-৮০ শতাংশ অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাতের। আনুষ্ঠানিক খাতকে রাজস্বের জন্য চাপ দিয়ে লাভ কী হবে, যদি না আমরা নীতির মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাতের অর্থনীতিকে আনুষ্ঠানিক খাতে রূপান্তর করতে না পারি। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, গত সরকারের ফেলে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। মুদ্রাস্ফীতি এখনো উপরে, প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে বিশ্বব্যাংক- এগুলো সবই সত্য। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি যেখানে আইসিইউতে চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফেরত আনতে পেরেছি। আইএমএফের সঙ্গে শক্ত হাতে ডিল করতে পেরেছি। এটা আমাদের জন্য বড় অর্জন।
