Logo
Logo
×

দ্বিতীয় সংস্করণ

চার সংকটে কুরবানির পশুর চামড়া বাণিজ্য

বাংলাদেশ থেকে কাঁচা চামড়া নিতে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি -বাণিজ্য উপদেষ্টা

Icon

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতিসহ চার সংকটের মুখে পড়ছে কুরবানির পশুর চামড়া বাণিজ্য। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ থাকায় একধরনের উদ্বেগে আছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। যে কারণে এক দিনের কাঁচা চামড়ার মৌসুমি ব্যবসা ঘিরে অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করছেন অনেকে। এর মধ্যে সিন্ডিকেটের জিম্মি থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের রক্ষায় রপ্তানির অনুমতি ও মূল্য বাড়িয়ে কাঁচা চামড়ার দর বেঁধে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটি ভালোভাবে নিচ্ছেন না ট্যানারি শিল্পের মালিকরা। তারা মনে করছেন এ উদ্যোগ সংকট তৈরি করতে পারে। সূত্র মতে, অর্থ বিনিয়োগে সতর্কতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, রপ্তানি বাণিজ্য উন্মুক্ত এবং বেশি মূল্য বেঁধে দেওয়াকে সংশ্লিষ্ট শিল্পের উদ্যোক্তারা সংকট হিসাবে দেখছেন। কিন্তু ভিন্ন চোখে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাদের মতে, বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখেই অভ্যন্তরীণ বাজারের কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বেঁধে দেওয়া দামে কেনাবেচা হলে কোনো ধরনের লোকসানের আশঙ্কা থাকবে না। আর প্রতিবছর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের লোকসানের মুখে ফেলে দেয় চামড়ার বাজারের সিন্ডিকেট। মূল্যের পতন ঘটিয়ে পানির দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। এটি এ বছর যাতে করতে না পারে, সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যে কারণে রপ্তানির বাজার তিন মাসের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে পরে যেন সেটি বিক্রি করতে পারে, সে ব্যবস্থাও সরকার নিয়েছে। এজন্য কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যে।

এদিকে দীর্ঘদিন ওয়েট ব্লু ও কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধ করে রাখা হয়েছে ট্যানারি মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু কুরবানি ঈদের পরবর্তী তিন মাস সেটি খুলে দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে চীন ও ভিয়েতনামে সরকারিভাবে যোগাযোগ করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে পশুর চামড়া আমদানি করার জন্য।

জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীকে সরাসরি অনুরোধ করা হয়েছে আমাদের ওয়েট ব্লু চামড়া আমদানির জন্য। এছাড়া বেইজিংয়ে অবস্থানরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করছেন। চীনের পাশাপাশি ভিয়েতনামে বাংলাদেশের কাঁচা চামড়া রপ্তানির ব্যাপারেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমই) সূত্রমতে, এ বছর কুরবানির পশুর চামড়ার সংখ্যা (গরু, ছাগল ও ভেড়া) ১ কোটি ১৫ লাখ পিস ছাড়িয়ে যেতে পারে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল এক কোটিরও বেশি। ইতোমধ্যে এই চামড়া সংগ্রহ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ট্যানারি মালিক, আড়ত মালিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মধ্যে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশে অনেকে অর্থ বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না। আবার বিনিয়োগ করলেও খুব হিসাবনিকাশ করছেন। যদিও এ মৌসুমে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংকগুলো চামড়া কেনায় ঋণ দেওয়া কমিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খানও ব্যাংক ঋণ কম দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ বছর কুরবানির পশুর চামড়া কিনতে ২৩২ কোটি টাকা ঋণ দেবে ব্যাংকগুলো, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা কম। ২০২৪ সালে চামড়া কেনার জন্য ২৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল ব্যাংকগুলো। চামড়া খাতে খেলাপি প্রবণতা বেশি হওয়ায় প্রতিবছরই কমছে ঋণের পরিমাণ। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে আগ্রহের ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান যুগান্তরকে বলেন, আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, চামড়া বাজারে একধরনের শঙ্কা রয়েছে। কারণ, প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম গড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা বাড়িয়েছে। ৭০০ টাকা দিয়ে একটি গরুর কাঁচা চামড়া কেনা হলে তিনশ টাকা খরচ হবে লবণ ও শ্রমিকের পেছনে। এরপর এক হাতবদল হলে আরও একশ টাকা বাড়বে। এতে চামড়ার মূল্য ১১৫০ টাকায় দাঁড়ায়। সেটি ট্যানারির মালিকের কাছে কত টাকা বিক্রি করা হবে, আর তা কিনে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রপ্তানি করতে পারবে কি না, সেটি চিন্তার বিষয়।

অবশ্য বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন মূল্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমরা যেহেতু বিনামূল্যে লবণ দিচ্ছি, প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং চামড়ায় লবণ লাগাতে যে শ্রম ব্যয় হয়, সেসব বিবেচনায় নিয়েই এবার চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছি। ফলে এবার যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা যৌক্তিক। প্রসঙ্গত, এ বছর রাজধানীসহ ঢাকায় কুরবানির গরুর চামড়ার মূল্য (লবণ মিশ্রিত) সর্বনিম্ন ১৩৫০ টাকা এবং মফস্বলের গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৫০ টাকা। আর বর্গফুট হিসাবে ঢাকার গরুর চামড়ার প্রতি বর্গফুটের মূল্য ৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে চামড়ার মূল্য ৬০ টাকা। মূল্য বিশ্লেষণে গত বছরের তুলনায় আসন্ন কুরবানির গরুর চামড়ার মূল্য প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা বেড়েছে। খাসির লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ২৭ টাকা এবং বকরির ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মূল্য গত বছরের তুলনায় দুই টাকা বেড়েছে।

রপ্তানি ব্যুরোর সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১০৬ কোটি মার্কিন ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। বৈশ্বিক বাজারে দেশের চামড়া রপ্তানি কিছুটা বাড়ছে, যা ইতিবাচক হিসাবে দেখা হচ্ছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম