গুমের ঘটনা তদন্তে
জাতিসংঘের সহযোগিতা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা
যুগান্তর প্রতিবেদন ও বাসস
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত দেড় দশকে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তে জাতিসংঘের যেকোনো ধরনের সহযোগিতা বাংলাদেশ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আমি চেয়েছিলাম, জাতিসংঘ আমাদের চলমান তদন্ত প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হোক। এতে প্রক্রিয়াটি আরও শক্তিশালী হবে। সোমবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতিসংঘের গুম বা নিখোঁজবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের (ডব্লিউজিইআইডি) ভাইস-চেয়ারপারসন গ্রাজিনা বারানোস্কা এবং সদস্য আনা লোরেনা ডেলগাডিলো পেরেজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি একথা বলেন।
এদিকে ডব্লিউজিইআইডির ভাইস-চেয়ারপারসন গ্রাজিনা বারানোস্কা ও আনা লোরেনা ডেলগাডিলো পেরেজ বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মো. রুহুল আলম সিদ্দিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গুম এবং বলপূর্বক অন্তর্ধান প্রতিরোধে কীভাবে সহায়তা করতে পারে, তা জানতে চেয়েছে।
ওদিকে, ভবিষ্যতে কোনো সরকারের মদদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যাতে কেউ গুমের শিকার না হন, সেজন্য স্থায়ী কমিশন গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সচিবালয়ে এক বৈঠক শেষে তিনি স্থায়ী কমিশন গঠনের জন্য আগামী এক মাসের মধ্যে আইন প্রণয়ন করার কথাও জানান।
এছাড়া, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, কমিশনে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৮৩০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। সব অভিযোগ কমিশন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করছে।
প্রধান উপদেষ্টা ডব্লিউজিইআইডির ভাইস-চেয়ারপারসন গ্রাজিনা বারানোস্কা এবং সদস্য আনা লোরেনা ডেলগাডিলো পেরেজকে বলেন, সরকার ডিসেম্বর পর্যন্ত কমিশনের মেয়াদ বাড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, তাদের নানাভাবে হুমকি দেয়া হলেও কমিশন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। তারা যখন সর্বশেষ প্রতিবেদন জমা দিল, আমি বলেছিলাম, দর্শনার্থীদের জন্য একটি ‘ভয়ের জাদুঘর’ থাকা উচিত। আপনাদের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। আমাদের সহায়তা ও একসঙ্গে কাজ করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, ১৩ বছর পর জাতিসংঘের একটি দলকে এখানে স্বাগত জানাতে পারছি। আমরা চাই আপনারা আমাদের কমিশনের কাজকে সহায়তা করুন এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে দিকনির্দেশনা ও শক্তি জোগান।
বারানোস্কা জানান, ২০১৩ সাল থেকে তারা বাংলাদেশে গুম ইস্যুতে কাজ করার চেষ্টা করছেন এবং তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, তদন্ত কমিশন ও এর কাজ আপনার সরকারের এক বিশাল প্রতিশ্রুতি। এজন্য আপনাদের ধন্যবাদ। এটি আমাদের জন্য এক বিশাল সম্মান।
তিনি আরও জানান, তারা ঢাকার বাইরে গিয়ে ভুক্তভোগী, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা গুমের ঘটনা প্রতিরোধে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ সনদে (আইসিপিপিইডি) বাংলাদেশের সংযুক্তির প্রশংসা করেন। তবে এ ক্ষেত্রে এখনো অনেক কিছু করার রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন।
গুম প্রতিরোধে সহায়তা করতে চায় জাতিসংঘ : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশে ডব্লিউজিইআইডি’র ভাইস-চেয়ারপারসন গ্রাজিনা বারানোস্কা এবং আনা লোরেনা ডেলগাডিলো পেরেজ ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত গুরুপূর্ণ পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে বলপূর্বক অন্তর্ধান থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা জোরপূর্বক অন্তর্ধানসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাজ এবং প্রতিশ্রুতিরও প্রশংসা করেছেন।
এ সময় পররাষ্ট্র সচিব মানবাধিকার সমুন্নত, সুরক্ষা ও প্রচার এবং ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের অটল সংকল্পের ওপর জোর দেন। তিনি এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য গ্রুপের সমর্থন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তাকে স্বাগত জানান।
গুম ঠেকাতে স্থায়ী কমিশন হবে : আসিফ নজরুল বলেন, বর্তমান গুম কমিশন যেখানে কাজ শেষ করবে, পরবর্তী কমিশন সেখান থেকে কাজ শুরু করবে। গুমসংক্রান্ত কমিশন গঠন ও আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়ায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল আমাদের প্রশংসা করেছে। এ বিষয়ে তারা আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, এই আইন হলে যেকোনো সরকারের জন্য কাউকে গুম করা অনেক রিস্ক ও কষ্টসাধ্য হবে। এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, বিএনপি, জামায়াত নেতারা নিজেই গুমের শিকার হয়েছেন। এনসিপি ও ইসলামি দলগুলো গুমের ব্যাপারে সোচ্চার রয়েছে। যারাই ক্ষমতায় আসুক, এমন কিছু করবে বলে মনে হয় না। অতীতে যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের ‘মিসিং সার্টিফিকেট’ দিতে আইনে বিধান যুক্ত করা যায় কিনা, তা চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
বৈঠক শেষে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের প্রধান ও ওয়ার্কিং গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান গ্রাজিনা বারানোস্কা বলেন, ঢাকা জাতিসংঘের গুম সনদে স্বাক্ষর করলেও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এই সংকট কাটানোর সব থেকে সহজ ও দ্রুততর উপায় হচ্ছে, গুমের শিকার পরিবারগুলোর কথা শোনা। বারানোস্কা আরও বলেন, গুমবিষয়ক সনদ স্বাক্ষরের পরে আমরা বাংলাদেশে এসেছি। সফরটি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাছে ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা করাই আসল বিষয়। এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে।
কমিশন সব অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করছে : গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিশনে অদ্যাবধি গুমসংক্রান্ত এক হাজার ৮৩০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। কমিশন সব অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করছে। রাজধানীর গুলশানে কমিশনের কার্যালয়ে ডব্লিউজিইআইডির ভাইস-চেয়ার গ্রাজিনা বারানোস্কা এবং সদস্য আনা লোরেনা ডেলগাডিলো পেরেজের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। কমিশনের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানা গেছে।
কমিশনের সভাপতি বলেন, গুমের শিকার হয়ে ফেরত না আসা ১০০ অভিযোগ পুলিশের কাছে তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভিক্টিম ও তাদের পরিবারের সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহীতে তিনটি কনসালটেন্সি সভা করা হয়েছে। কমিশন ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে দুটি অন্তর্বর্তী রিপোর্ট হস্তান্তর করেছে।
কমিশনের সদস্য মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, লজিস্টিক, জনবল সংকট ও রাজনৈতিক নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও কমিশন দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতিনিধি দলের সদস্যরা কমিশনের কাজের প্রশংসা করেছেন। তারা গুমের প্রতিটি ঘটনার তদন্ত, অভিযুক্তদের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ এবং প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়া গুম থেকে ফেরত না আসা ব্যক্তিদের সন্ধানে ‘সার্চ কমিটি’ গঠনে করণীয় বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার কথা উল্লেখ করেন। পাশাপাশি সুষ্ঠু তদন্তের জন্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করাসহ কমিশনের কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের আশা প্রকাশ করেন। ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী এবং মো. নূর খান উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ডব্লিউজিইআইডির দুই সদস্যের প্রতিনিধি দল রোববার ঢাকায় এসেছে। চার দিনের বাংলাদেশ সফরকালে তারা আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব, গুমসংক্রান্ত কমিশনের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গুমের শিকার পরিবারগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবেন। শুক্রবার তারা ঢাকা ছাড়বেন।
