Logo
Logo
×

দ্বিতীয় সংস্করণ

আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস আজ

দেশের সীমান্ত এখন মাদকের রুট

২৯ জেলার ১৬২ সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে বেশি মাদক

Icon

আবদুল্লাহ আল মামুন

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের সীমান্ত দিয়ে অবাধে ঢুকছে মরণঘাতী নানা মাদক। ২৯টি সীমান্তবর্তী জেলার ১৬২টি রুট দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা, আইস, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, টপেন্টাডল, কোকেনের মতো ভয়াবহ মাদক। পরে বাস, ট্রাকসহ নানা পরিবহণে ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। শুধু এই মাদক নয়, ধনী পরিবারের সন্তানদের প্রিয় এলএসডি ও পশ্চিমা মাদকও ঢুকছে এসব সীমান্ত দিয়ে। মূলত মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত পথের অনেক জায়গাই অরক্ষিত থাকায় মাদক কারবারিদের অপতৎপরতা থামানো যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে মাদক আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্যে এসব বিষয় উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের বেশি সময়ে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হলেও দলের প্রভাবশালী অনেকে জড়িত ছিলেন কারবারে। সরকারের পতনে চক্রের মূল হোতারা আত্মগোপনে চলে গেলেও নতুন অনেকে যুক্ত হয়েছে মাদক সিন্ডিকেট। এমন সংকটের মধ্যেই আজ পালিত হবে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান : সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়।’ দেশকে মাদকমুক্ত করতে রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ না করে পরিবার ও সমাজের সবাইকে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলে সমাজ ও অপরাধ গবেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না সত্ত্বেও দেশের সর্বত্র মাদকে সয়লাব। এতে বোঝা যায় সীমান্ত পথে অথবা আকাশপথে এসব মাদক দেশে প্রবেশ করছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সীমান্ত সুরক্ষায় বিচ্ছিন্ন কোনো কার্যক্রম পরিচালনা না করে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। নয়তো মাদকের লাগাম টানা সম্ভব হবে না।

ডিএনসির তথ্য বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে দেশের আইন সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ২০ কোটি ১১ লাখ ৫৮ হাজার ২২১ পিস ইয়াবা জব্দ করেছে। এ সময়ে ২ হাজার ১৯৩ কেজি হেরোইন, ১৫৩ কেজি কোকেন, ২২৩ কেজি আফিম, ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫২ কেজি গাঁজা, ৩৩ লাখ ৪৩ হাজার ৬৩৭ বোতল ও ৬৪৬ লিটার ফেনসিডিল জব্দ করা হয়। অন্যদিকে, চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ৫৯ পিস। এ সময়ে ৬৩ কেজি হেরোইন, ১০ কেজি কোকেন, ৮০০ গ্রাম আফিম, ৩৫ হাজার ১২১ কেজি গাঁজা, ১ লাখ ৭৫ হাজার ২২৭ পিস ও ৭৬ লিটার ফেনসিডিল, ৬৮ হাজার ৪৬৫ বোতল ও ৫ হাজার ১১৯ লিটার বিদেশি মদ, ৮ হাজার ৫২১ ক্যান ও ৫ হাজার ৩৫৪ বোতল বিয়ার জব্দ করা হয়েছে।

ডিএনসির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ৩২টি জেলার মধ্যে ভারতের সঙ্গে ৩০টি ও মিয়ানমারের সঙ্গে ৩টি জেলার সীমান্ত সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রাঙামাটির সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমার উভয় দেশের সীমান্ত রয়েছে। গত প্রায় দুই দশক ধরে ইয়াবার চালান সব থেকে বেশি আসছে ১৮টি সীমান্ত রুট দিয়ে। এর মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালী, মনাখালী, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, রৌমারি চর, আমতলি, পালংখালী, মরিচ্যা, রেজুখাল, নাইক্ষ্যংছড়ির গর্জনবুনিয়া ও তুমব্রুম অন্যতম। এছাড়াও রাঙামাটির রাঙ্গুনিয়ার রাজারহাট, পোমরা মালিরহাট ও চন্দ্রঘোনার খ্রিষ্টানপল্লী, খাগড়াছড়ির রামগড় এবং কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলা দিয়েও ঢুকছে ইয়াবা। মূলত মিয়ানমারের মংডু, নাইখোংদিয়া, সিতারগোলা, সিত্তে, আললে থান খেয় অঞ্চল থেকে আসছে ইয়াবা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের পর একই রুটে ব্যাপকভাবে ঢুকছে মরণঘাতী আইস। কক্সবাজারের ইয়াবার রুট, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত পথ দিয়ে ঢুকছে হেরোইন। মিয়ানমার ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকেও আসছে হেরোইন। সম্প্র্রতি আফগানিস্তানে পপি চাষ কমে যাওয়ায় মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কক্সবাজারে হেরোইনের চালান বৃদ্ধি পেয়েছে।

সূত্র বলছে, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ময়মনসিংহ, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, নঁওগা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে আসছে ফেনসিডিল। বিশেষ করে ‘কোভিন ফসফেট’ মিশ্রিত ফেনসিডিল ভারতের চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার, আসাম প্রদেশের ধুবরী ও সাউথ সালমারা মানকাচর জেলা দিয়ে প্রবেশ করছে। গাঁজা প্রবেশ করছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নঁওগা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত পথ দিয়ে। ভারতের আসামের ধুবরী, কারিমগঞ্জ, কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, ত্রিপুরার আগরতলা সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে গাঁজা। বিদেশি মদ ঢুকছে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর সীমান্ত পথ দিয়ে। এছাড়াও টপেন্টাডল নামের ভয়ানক মাদক প্রবেশ করছে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, দিনাজপুর সীমান্ত দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা ও দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে ঢুকানো হচ্ছে ভয়ংকর এই মাদক।

সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করা বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, আওয়ামী লীগ আমলের মাদক কারবারিরা পট পরিবর্তনের পর গা ঢাকা দিয়েছে। এতে কিছুদিন সীমান্তে মাদক কারবার কমলেও এসব সিন্ডিকেটে অনেক নতুন মুখ যুক্ত হয়েছে। মূলত স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সীমান্তের ওপারের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশে মাদকের চালান আনছেন।

ডিএনসির পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশন্স) মো. বশির আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ডিএনসিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো মাদক নির্মূলে সর্বাত্মক আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এরপরও কারবারিরা নিত্যনতুন কৌশলে কখনো শুকনো মরিচ, কখনো কাঁঠাল, আবার কখনো কুমড়ার ভেতরে করেও মাদক পাচার করছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সারা দেশেই মাদকবিরোধী অভিযান তৎপর রয়েছে। তবে জনবল সংকট ও সরঞ্জাম ঘাটতির কারণ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

ডিএনসি সূত্রে জানা গেছে, সংস্থার ২ হাজার ৫৫ জন জনবলের মধ্যে ১ হাজার ৬০০ জন ফাংশনাল কাজ করেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এছাড়াও সরঞ্জামের ঘাটতিও রয়েছে। ডিএনসির এমন জেলা কার্যালয় আছে, যেখানে অভিযান পরিচালনার মতো কোনো গাড়ি নেই।

আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস আজ : ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় প্রতিবছরের ২৬ জুনকে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এর মূল লক্ষ্য মানব সম্প্রদায়কে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তালমিলিয়ে এবারও আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হবে।

ডিএনসি সূত্র জানিয়েছে, দিবসটি উপলক্ষ্যে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে উৎসববন্ধন, আলোচনা সভা ও পুরস্কারবিতরণী আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম