ঘরে ঘরে জ্বর
হাসপাতালে বিলম্বে আসায় মারা যাচ্ছে অনেক রোগী
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এ পাঁচ মাস ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ থাকে। এবার ডেঙ্গুর সঙ্গে ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড, মৌসুমি জ্বর ও করোনাভাইরাসজনিত জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক, বৃদ্ধসহ সব বয়সি মানুষ। জেলা-উপজেলা হাসপাতাল থেকে শুরু করে বিভাগীয় পর্যায়ের টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের বেশির ভাগই জ্বরের উপসর্গের কথা বলছেন। জ্বর হলেই ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাস ভেবে সবার মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। কিন্তু জ্বরের কারণ ডেঙ্গু, করোনা, নাকি ভাইরাল ফিভার না বুঝেই অনেকে ইচ্ছেমতো ওষুধ সেবন করছেন। শারীরিক পরিস্থিতি বেশি অবনতি হলেই হাসপাতালে আসছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু ও করোনায় জ্বরের উপসর্গ প্রায় একই রকম দেখা যাচ্ছে। পরীক্ষা ছাড়া এসব রোগী আলাদা করা অনেক সময় কঠিন হচ্ছে। কিন্তু অনেকে না বুঝে বিলম্বে হাসপাতালে আসছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে কোন ধরনের জ্বরে ভুগছেন। এতে সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন অনেক রোগী। রোগ শনাক্তে রোগীদের দ্বিধার কারণে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক, রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বর কোনো রোগ নয়; এটি রোগের একটি উপসর্গ। তাই জ্বর হওয়াকে কোনো রোগের সতর্কবার্তা বলা যেতে পারে। বিভিন্ন কারণে জ্বর হতে পারে। ঠাণ্ডা বা সর্দি-কাশিতে বেশি জ্বর হয়। শরীরের ভেতরে কোনো কারণে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ হলেও জ্বর হতে পারে। ডেঙ্গু, করোনাভাইরাস, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া রোগের প্রাথমিক লক্ষণও জ্বর। টিকা নিলে, ফোঁড়া বা টিউমার হলে, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন, পিরিয়ডের কারণে, আকস্মিক ভয় পেলে বা মানসিক আঘাত পেলেও জ্বর হতে পারে।
রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালসহ একাধিক চিকিৎসাকেন্দ্রের মেডিসিন ওয়ার্ড ঘুরে বেশির ভাগ রোগীকে সাধারণ ভাইরাস ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত জ্বর নিয়ে ভর্তি থাকতে দেখা গেছে। রোগীদের কারও শরীর ব্যথা, হালকা জ্বর। কারও কপালে বা মাথার পেছনে যন্ত্রণা। শরীরে শীত শীত ভাব, কাঁপুনি, মাথা ব্যথা, হাত-পায়ের গিঁটে ব্যথা, খাবারে অরুচি, নাক দিয়ে অঝোরে পানি পড়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া, চুলকানি, ঠান্ডা, সর্দির মতো উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা করাতে দেখা গেছে। সব জ্বরই ভাইরাসজনিত। ডেঙ্গু ও করোনা, উপসর্গ প্রায় একই রকম। অনেক ক্ষেত্রে উপসর্গ বুঝে পরীক্ষা করেও নেগেটিভ ফল পাওয়া যাচ্ছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ৩১৩নং ওয়ার্ডের ৪২ নম্বর শয্যায় টানা এক সপ্তাহ জ্বরের চিকিৎসা নিয়ে মঙ্গলবার ছাড়পত্র পায় ছয় বছরের নাজমুল হোসেন। শিশুটির নানি বিথি খাতুন বলেন, মাসখানেক ধরে নাতি জ্বরে ভুগছিল। নাপা (প্যারাসিটামল) খাওয়ালে জ্বর ছেড়ে যায়। দু’একদিন পর আবার আসে। গত বুধবার থেকে বেশি হয়। জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যথা, পিঠে এবং মাংসে ব্যথা, চোখের চার পাশে এবং পেছনে ব্যথা, পেটে ব্যথা, স্বাদের পরিবর্তন এবং গায়ে লালচে ভাব দেখা দেয়। ২৩ জুন টেস্ট করে ডেঙ্গু ধরা পরে। তারপর এখানে ভর্তি করি। আজ ছুটি দিয়েছে।
এই হাসপাতালের ডিউটি অফিসার ডা. রাতুল যুগান্তরকে বলেন, মেডিসিন ওয়ার্ড ভর্তি রোগীদের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই জ্বর নিয়ে আসছে। ডেঙ্গুজ্বর অতিরিক্ত মাত্রার অর্থাৎ ১০২ থেকে ১০৫ ফারেনহাইট হয়ে থাকে। এ সময় জ্বরে আক্রান্ত হলে কালক্ষেপণ না করে জ্বরের শুরুর পাঁচ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা উচিত। এর সঙ্গে রক্তের সিবিসি, এসজিপিটি, এসজিওটি টেস্ট করা।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন, ডেঙ্গু পজেটিভ রোগীর চিকুনগুনিয়ার চেয়ে গায়ে ব্যথা কম হয়। চিকুনগুনিয়ায় হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা, মাংসের পেশিতে অনেক বেশি ব্যথা হয়ে থাকে। গায়ে র্যাশ দেখা দেয়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পাতলা পায়খানা হওয়া, পেট ব্যথা এগুলো একটু বেশি দেখা যায়। সাধারণ জ্বরে সর্দি-কাশির সঙ্গে হালকা গায়ে ব্যথা থাকে। এসব জ্বর চার দিনের মধ্যে এমনিতে সেরে যায়। জ্বর যদি চার দিনের বেশি থাকে সেক্ষেত্রে ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, আগে করোনা রোগীদের জ্বরের সঙ্গে কাশি, গন্ধ না পাওয়া, শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ ছিল। এখন করোনা পজেটিভ রোগীও জ্বরের সঙ্গে গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, মাথা ব্যথার মতো উপসর্গ নিয়ে আসছে। এসব রোগী আলাদা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, বৃষ্টির জমা পানিতে এডিস মশার লার্ভার জন্ম হচ্ছে। মশার কামড়ে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বাড়ছে। কিন্তু মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংসে তেমন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে না। ঢাকার বাইরেও এডিসের উপদ্রব বাড়ছে। ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া দেখা দিয়েছে। জ্বরের সঙ্গে ঘরে ঘরে সর্দি কাশি জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম যেমন; শিশু, বয়স্ক, রোগাক্রান্ত ব্যক্তি (ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি, হার্টের সমস্যা, ক্যানসার আক্রান্ত) ও গর্ভবতীরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে ডেঙ্গু ছাড়াও কোনো ধরনের জ্বর বা রোগ যেন না হয় সেদিকে জোর দিতে হবে। প্রতিকার ও প্রতিরোধে জনগণ ও প্রশাসন সমন্বিতভাবে ঘরে ও বাইরে মশা নির্মূলে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. এসএম খালিদ মাহমুদ শাকিল যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গু, করোনা, টাইফয়েড, ভাইরাল ফিবার যেকোনো রোগেই জ্বর হতে পারে। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। জ্বর হলেই ডেঙ্গুর বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। জ্বরের প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এনএস-১ এন্টিজেন পরীক্ষা করতে হবে। এরপর আরটি-পিসিআর টেস্ট করে করোনাভাইরাস কিনা নিশ্চিত হতে হবে।
২৪ ঘণ্টায় আরও ১ মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩৮৬ জন : এদিকে সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৮৬ জন রোগী। এসব রোগীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৬৩ জন ভর্তি হয়েছেন বরিশাল বিভাগে। সেই সঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ভর্তি রোগীদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৬৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭৩ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩৮ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩০ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৬ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩৯ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৮ জন রয়েছেন।
এছাড়াও গত ২৪ ঘণ্টায় ৩২২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৯ হাজার ৪০৯ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ১০ হাজার ৬৮২ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৪৩ জনের।
