Logo
Logo
×

স্বজন সমাবেশ

মুক্তিযোদ্ধার মা

Icon

এইচএম কবির আহমেদ

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাফি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। রাফির বাবা আরেকটা বিয়ে করবেন। রাফির মা তাকে বারণ করলেন। বললেন, তুমি বিয়ে করবে না, যদি কর, আমি একমাত্র ছেলে রাফিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব। শেষ পর্যন্ত রাফির বাবা আরেকটা বিয়ে করেই ফেললেন! রাফির মা আফিয়া তার পুত্রের হাত ধরে স্বামীর প্রাসাদ ত্যাগ করে ছোট কুঁড়েঘরে আশ্রয় নেন। ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে থাকেন। রাফি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স শেষ করে।

১৯৭১ সাল ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু। তার বন্ধুরা যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। তারা ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করে। বন্ধুরা রাফিকে বলল, চল আমাদের সঙ্গে অপারেশন করবি। তুই তো বন্দুক-পিস্তল চালাতে জানিস।

রাফি বলল, এ জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নেই, আর মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা অনুমতি দিলেই কেবল আমি যুদ্ধে যেতে পারি। রাফি মাকে বলল, মা আমি কি যুদ্ধে যাব। মা বললেন, নিশ্চয়ই তোমাকে আমার প্রয়োজনের জন্য মানুষ করিনি, দেশ ও দশের জন্যই তোমাকে মানুষ করা হয়েছে।

রাফি যুদ্ধে গেল। দুটো অপারেশনে অংশ নিল। তাদের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হল। গেরিলারা আশ্রয় নিল। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট। ধরা পড়ল ক্র্যাক প্লাটুনের একদল সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। সেসময় রাফিকেও আটক করা হয়। তাকে ধরে নিয়ে রাখা হল রমনা থানাসংলগ্ন ড্রাম ফ্যাক্টরি এক মিলিটারি টর্চার সেলে।

গরাদের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা রাফিকে দেখতে গেছেন তার মা। চিনতে পারেন না। প্রচণ্ড মারের চোটে চোখ-মুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে, ভ্রু’র কাছটা কেটে গভীর গর্ত হয়ে গেছে।

মা, কী করব? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে সব। সবার নাম বলতে বলে।

বাবা, তুমি কারোর নাম বলনি তো?

না মা, বলিনি। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরও মারে, যদি বলে দেই। বাবারে যখন মারবে তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য কর। কারও নাম বল না।

আচ্ছা মা। মাগো তোমার হাতের ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। তোমার কোলে মাথা রেখে শুতে মন চাইছে। দু’দিন ভাত খাই না। কালকে দু’টা রুটি দিয়েছিল। আমি খেতে পারিনি। রাফির করুণ কথাগুলো মায়ের হৃদয়ে আঘাত করতে লাগল। আচ্ছা, কালকে ভাত নিয়ে আসব বলে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আফিয়া বেগমের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক, ছেলের গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগতে দেননি কোনো দিন। সেই ছেলেকে ওরা এভাবে মেরেছে!

পরদিন মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা আর বেগুন ভাজি টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে সারা রাত রমনা থানায় দাঁড়িয়ে থাকেন আফিয়া বেগম; কিন্তু রাফিকে আর দেখতে পাননি। তেজগাঁও থানা, এমপি হোস্টেল, ক্যান্টনমেন্ট সব জায়গায় খুঁজলেন, হাতে তখন টিফিন ক্যারিয়ার ধরা, কিন্তু রাফিকে আর খুঁজে পেলেন না। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন রাফিকে তার বন্ধুরা মুক্ত করে ঢাকার বাইরে নিয়ে গেছে যুদ্ধ করতে!

ছেলে একবেলা ভাত খেতে চেয়েছিল। মা পারেননি ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে। সেই কষ্ট-যাতনা প্রতিটা মুহূর্ত তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে! প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন বলে পথ চেয়ে বসে থাকেন আফিয়া। বিশ্বাস ছিল তার রাফি ফিরবে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হল। লাল-সবুজের বিজয় পতাকা পতপত করে বাংলার আকাশে উড়তে লাগল! চারদিকে আনন্দ মিছিল আর মিছিল। তিনি গর্ব করে বলছেন, আমিও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মা। তিনি অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন এবার দেশ স্বাধীন হয়েছে, যুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমার রাফি ফিরে আসবে! না জানি ছেলে আমার কেমন হয়েছে, শুকিয়ে গেছে আরও কত কল্পনায় আফিয়া বেগম মনে মনে তারই বান্ধবী সুফিয়ার মেয়ে আলিয়াকে রাফির বউ করে নেবেন বলে ছেলের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন।

এক-দু’দিন করে সপ্তাহ, মাস, বছর গড়িয়ে আজ প্রায় অর্ধ-শতাব্দী হল রাফি আজও ফেরেনি। দূর থেকে যাকেই দেখেন তাকেই তার রাফি মনে করে এগিয়ে যান মা! আজও আফিয়া বেগম তার রাফির জন্য প্লেটে ভাত নিয়ে অপেক্ষায় বসে আছেন।

মাথার চুলগুলো কালো থেকে ধবধবে সাদা রং ধারণ করেছে। এখন আর দু’পায়ে চলতে পারেন না। তিন পায়ে ভর দিয়ে চলেন। লাঠিতে টুকটুক করে পাড়ার ছেলেদের পেলেই বলেন আমার রাফিকে তোরা দেখেছিস!!

আজ শরীরটা কেমন করছে, হঠাৎ ভাবলেন যদি আমি মারা যাই আর আমার রাফি ফিরে আসে তাহলে ও যাবে কোথায়? কী করবে? তাই, তিনি কাগজ-কলম হাতে একটি পত্র লিখলেন, রাফির বাবার কাছে।

ওগো শোনো- তোমার ছেলে রাফি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যদি কোনো দিন আমার এ পত্র হাতে তোমার সামনে দাঁড়ায়, তাহলে প্লিজ তুমি আমার ছেলে তথা তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিও না। কাছে টেনে পিতার স্নেহ-আদরটুকু দিয়ে বুকে টেনে নিও। আমার রাফি যে পিতার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তুমি তাকে তাড়িয়ে দিও না।

আর আমাকে ক্ষমা করে দিও। যেদিন এ পত্র তোমার হাতে পৌঁছাবে হয়তো সেদিন আমি আর এ পৃথিবীতে নেই। আমার রাফিকে তুমি তোমার ছেলের আসন থেকে বঞ্চিত কর না প্লিজ!

ইতি-

তোমার আফিয়া

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম