Logo
Logo
×

স্বপ্নের আবাসন

বহুমুখী সংকটে ধুঁকছে আবাসন খাত

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বহুমুখী সংকটে ধুঁকছে আবাসন খাত

বহুমুখী সংকটে ধুঁকছে দেশের আবাসন খাত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বিক্রি কমে যাওয়া, ঢাকার মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপের জটিলতার কারণে ভবন নির্মাণ হ্রাস পাওয়া এবং নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিসহ নানামুখী সংকটে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। আবাসন খাতে নতুন নতুন প্রকল্প না হওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ফ্ল্যাট বা জমিতে বিনিয়োগও কমে গেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই।

আবাসন খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম আবাসন। দীর্ঘ সময় ধরে প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি বিক্রিতে মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। হচ্ছে না নতুন বিনিয়োগ। অনেক কোম্পানি পরিচালন খরচ মেটানোর জন্য লাভ ছাড়াই প্লট ও ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছে। অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না কর্মীদের। নানামুখী প্রতিবন্ধকতা গ্রাস করছে শিল্পটিকে। অথচ ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে এই খাতের অবদান প্রায় ৮ শতাংশ। তবুও এদিকে সরকারের সুদৃষ্টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

তারা বলেন, আবাসন খাত এবং লিংকেজ খাত মিলিয়ে ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু জনগণের মৌলিক চাহিদা স্বপ্নপূরণের এই ব্যাপক সম্ভাবনাময় খাত এখন ধুঁকছে। কয়েক বছর ধরেই জমির অভাব, নগর পরিকল্পনার অভাব ও দক্ষ শ্রমিকের অভাবের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছিল আবাসন খাত। এসব নিরসনে সরকারের দায়িত্ব আবাসনসংশ্লিষ্টদের পাশে থেকে সহযোগিতা দেওয়া। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারসংশ্লিষ্টরা বর্তমানে এই খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অসহযোগিতামূলক আচরণ করছে।

তারা আরও বলেন, দেশের বিদ্যমান সংকটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহও আবাসন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের প্রভাব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের বাড়তি সুদ এবং নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মতো ঘটনা রয়েছে। এসব কারণে রাজধানীতে ছোট ও মাঝারি ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি এক বছরের ব্যবধানে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমেছে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে যাওয়ায় ছোট ও মাঝারি আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। পাশাপাশি প্লট বা জমি বিক্রির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। মূলত রড ও সিমেন্টের মতো কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ড্যাপের কারণে ভবনের উচ্চতা অনেকাংশে হ্রাস পাওয়ায় ফ্ল্যাটের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তথ্যমতে, নানামুখী সংকটের কারণে আবাসন খাতে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমে গেছে। একই সঙ্গে ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণের কাজেও স্থবিরতা চলছে। মিলছে না চাহিদামতো ব্যাংক ঋণ। এমন পরিস্থিতিতে মুনাফা ছাড়া নির্মাণ ব্যয়েই ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কেউ কেউ। দেশের ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ সব সময় আবাসনে বিনিয়োগ করে থাকেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আত্মগোপনে। এসবও আবাসন খাতের বেচা-বিক্রিতে প্রভাব ফেলছে।

রিহ্যাব সদস্যদের কয়েকজন জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনাপ্রশ্নে আবাসনে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এ খাতে বিনিয়োগও কমে গেছে। সাধারণ মানুষও আগের মতো এই খাতে বিনিয়োগ করছেন না। আগে যারা বড় আকারের ফ্ল্যাট কিনতেন, তারা এখন নেই। উলটো তারাই এখন নিজেদের সম্পদ বিক্রিতে নেমেছেন। এছাড়া নতুন ড্যাপের কারণে ২০২৩ সাল থেকেই আবাসন খাতে মন্দা। যার কারণে রাজউকে নতুন প্ল্যান পাশ অনুমোন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। ফলে এ সময়ে যে পরিমাণ প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল, সে রকম হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ড্যাপ সংশোধন করার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। আবাসন খাতসংশ্লিষ্টরা দ্রুতই ড্যাপ জটিলতা নিরসনের আশা করলেও কার্যত তা হচ্ছে না।

তারা জানান, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪-২৫ সালে সব ক্যাটাগরির ফ্ল্যাট বিক্রি গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকায় ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে গেছে। আগে যেখানে একটি কোম্পানি মাসে পাঁচ থেকে আটটি ফ্ল্যাট বিক্রি করত, এখন তা কমে এক-দুটিতে দাঁড়িয়েছে। যাদের খুবই প্রয়োজন, তারাই শুধু কিনছেন। আর যাদের নিজেদের ফ্ল্যাট আছে, তারা নতুন করে কিনছেন না। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে আবাসন খাতের ব্যবসা ভালো হয়। দেশে আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে আবাসন খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে মধ্যবিত্তের জন্য ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্ট কেনা আসলেই কঠিন হয়ে পড়েছে।

তারা বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই ২৫ থেকে ৩০ বছরের জন্য গৃহঋণ দেওয়ার জন্য মর্টগেজ করপোরেশন রয়েছে। সেসব দেশের ফ্ল্যাটের ক্রেতারা ৩০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করে মর্টগেজ করপোরেশনে আবেদন করে। তখন ওই সংস্থা তাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থায় যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, অ্যাপার্টমেন্টে লোন বা গৃহঋণ দেওয়া সব সময়ই ঝুঁকিমুক্ত। মধ্যবিত্তরা আমাদের দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে যদি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া যায়, তাহলে আবাসন খাতের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চাঙা হবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি) এখনো গৃহঋণ দিচ্ছে। তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েও গৃহঋণের সমস্যাটি সমাধান করার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে আবাসন খাতের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা দরকার। আগামী ৩০ বছরে যেন হাত দিতে না হয়, সেভাবে সুপরিকল্পিতভাবে ড্যাপ ও অন্যান্য পরিকল্পনা করা দরকার। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ঢাকায় সব করতে চাইলে চাপ বাড়বে। পূর্বাচলের মতো ঢাকার বাইরে আরও বেশ কিছু আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। এসব করলেই স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য আবাসন সমস্যা ধীরে ধীরে কমে আসবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এখন বিপর্যস্ত অবস্থায়। এখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম নির্মাণ ও আবাসন শিল্প খাত। একই সঙ্গে স্থবিরতা নেমে এসেছে এই খাতের সঙ্গে সাড়ে চারশর বেশি লিংকেজ (সংযোগ) শিল্পের। এসব উপখাতের মধ্যে আছে-সিমেন্ট, রড, ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, টাইলস, রং, পাইপ ফিটিংস, স্যানিটারি ইত্যাদি। থমকে গেছে এসব খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পরিবারসহ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা। হুমকির মুখে পড়েছে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ। দ্রুত এই খাত উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার ফ্ল্যাট বেচাকেনা হতো। লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এখন বেচাকেনা নেই বললেই চলে। ফলে নির্মাণশিল্পের সঙ্গে জড়িত ৩৫ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে। আবাসন ও নির্মাণ খাতে অচলাবস্থা থাকায় চাহিদা কমে গেছে রড, সিমেন্ট, সিরামিকসহ অন্যান্য পণ্যের। ফলে সেসব খাতেও বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। এছাড়া সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ব্যয় অনেক বেশি। রয়েছে ভ্যাট-ট্যাক্সের অতিরিক্ত চাপ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ খাতের সাবলীলতা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য নিবন্ধন ফি, ভ্যাট-ট্যাক্স উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে হবে। সেই সঙ্গে নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। পাশাপাশি বিনা শর্তে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফ্ল্যাট, প্লট বা জমি কিনতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করার সুযোগ রাখতে হবে। এই উদ্যোগটি আবাসন খাতের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। পাশাপাশি এ খাতের ব্যবসায়ীদের উত্থাপিত দাবিগুলো সুবিবেচনায় নিতে হবে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলে আবাসন খাতের ব্যবসার উন্নতি হবে। টাকার প্রবাহ বাড়লে ফ্ল্যাটের বিক্রিও বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, আবাসন খাতের প্রধান সমস্যা রাজউকের মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপ। ২০২২ সাল থেকে এই মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে সংশোধনের আলোচনা চলছে। যার সুরাহা হয়নি এখনো। এটার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।

তিনি জানান, নতুন ড্যাপে ভবনের আয়তন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে আগে যেসব ডেভেলপার ভূমি মালিকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, তারা ভবন নির্মাণ করতে পারছে না। এজন্য ভূমি মালিকরা ডেভেলপারদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। সরকারকে বারবার বিষয়টি রিহ্যাবের পক্ষ থেকে বোঝানো হলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম