Logo
Logo
×

খেলা

কানাডা প্রবাসী ফুটবলার রকিবের দুঃখগাথা

Icon

মোজাম্মেল হক চঞ্চল

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘তুমি এত ছোট, ক্লাস সিক্সে পড়। ফুটবল খেলবে?’ শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কথায় আমি অনেক কেঁদেছিলাম। আজ সেই আমি ১৬ বছর ধরে কেঁদেছি। মাঠ থেকে আজও অবসর নিতে পারিনি’, বললেন সাবেক তারকা মিডফিল্ডার মোহাম্মদ রকিব। ২০০৪ সালের অক্টোবরে ভুটানে আবাহনীর হয়ে ক্লাব কাপ জিতে ফেরার পর টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে কর্তাদের সঙ্গে তিক্ততা তৈরি হয় রকিবের। খেলা ছাড়ার সময় তখনও হয়নি। আরও দু’তিন বছর খেলতে পারতেন। কিন্তু আবাহনীর তৎকালীন ফুটবল ম্যানেজমেন্ট রকিবকে সেই সুযোগ দেয়নি। সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয় তাকে। স্বাধীনচেতা রকিব অভিমানী হয়ে ওঠেন। খেলার সুযোগ না পাওয়ায় দেশান্তরিত হন। পাড়ি জমান কানাডায়। ওখানেই থাকেন স্ত্রী জিহান সাজেদ। দুই সন্তান জিনান হোসেন ও রায়েফ হোসেনকে নিয়ে। প্রবাসী জীবন রকিবকে অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিলেও মানসিক সুস্থতা কেড়ে নিয়েছে। মাঠ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবলকে বিদায় জানানোর সুযোগ না পাওয়ার বেদনায় পুড়েছেন রকিব।

একসময় ভারতেন ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতি করবেন। আবাহনীতে থাকতেই আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক হয়েছিলেন। কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর রাজনীতি থেকেও ইস্তফা দিতে হয় তাকে।

করোনাভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। কানাডা প্রবাসী এই ফুটবলারের দেশের জন্য মন কাঁদে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়। ‘স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালোই আছি। দু’জনই কাজ করি, কিন্তু ফুটবল ছাড়তে পারিনি’, একথা রকিবের। তিনি যোগ করেন, ‘সপ্তাহে দু’দিন বাচ্চাদের ফুটবল অনুশীলন করাই। বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানি ও স্থানীয় কয়েকটা বাচ্চা রয়েছে আমার ক্যাম্পে। করোনার কারণে অনুশীলন বন্ধ। বাচ্চারা যখন বলে লাথি মারে তখন অতীতে ফিরে যাই। দেশের জন্য ফুটবল খেলেছি। প্রত্যেক ফুটবলারের স্বপ্ন থাকে গ্যালারি ভরা দর্শকদের সামনে অবসর নেয়ার। আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আমি ক্লাব পলিটিক্সের শিকার হয়ে খেলা ছাড়তে বাধ্য হই। আসলে আমাকে খেলা থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। ওই সময় আবাহনী ক্লাব কর্মকর্তাদের গ্রুপিংয়ে বলির পাঁঠা হয়ে কানাডা পাড়ি জমাই রুটি-রুজির জন্য।’

রকিবের কথা, ‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হব। সারা দেশে আমার নাম হবে, কখনও তা ভাবিনি। আমার ছেলেবেলার দিনগুলো কেটেছে এলোমেলোভাবে। কখনও গ্রামে কখনও ঢাকায়। শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম চরকুমারিয়া। সবুজাভ গ্রামটিকে দূর থেকে মনে হবে যেন আকাশ ছুঁয়েছে। সকালবেলা ক্ষেতের আল ধরে বই বগলদাবা করে ছুটতাম স্কুলে। ছুটির ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে দিতাম ভোঁ দৌড়। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতাম। ১৯৮৩ সালে আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। থানা সদরে টুর্নামেন্ট হবে। ঢাকার নামকরা ফুটবলাররা আসবেন। তাদের একজন মোহামেডানের মনু। ভেদরগঞ্জের দলে আমাকে কিছুতেই রাখবেন না উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ম্যাচে বদলি হিসেবে আমাকে মাঠে নামাতে বাধ্য হলেন তিনি। আমার দেয়া দুই গোলে ভেদরগঞ্জ ৩-১ ব্যবধানে ঢাকার দলকে হারিয়ে দিল। আমার নাম ছড়িয়ে পড়ল। আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হল। আজ এ গ্রাম তো কাল অন্য গ্রাম। খাওয়া-দাওয়া জার্সি ফ্রি। একবার গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছি। আবাহনী মাঠে ফুটবলারদের অনুশীলন দেখতে যাই। ওখানে দেখতাম কয়েকজন ফুটবলার অনুশীলন করছেন। সাহস করে বললাম আমাকে প্র্যাকটিসে নেবেন? সুযোগ পেলাম, আমার দুই ভাই আমাকে চলন্তিকা ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় ওরা আমাকে নেয়নি। ১৯৮৬ সালে পাইওনিয়ার দল এমএইচসিসিতে যোগ দিই। সিটি ক্লাব পিডব্লুডি, ব্রাদার্স হয়ে নাম লেখাই মুক্তিযোদ্ধায়। আবাহনী ঘুরে মুক্তিযোদ্ধায় ফিরি। তারপর মোহামেডান হয়ে আবাহনীতে। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত খেলেছি জাতীয় দলে।’ আবেগময় কণ্ঠে রকিব বলেন, ‘মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। ঢাকায় খেলেছি, জাতীয় দলে খেলেছি। ফুটবলকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানোর ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তবে এখন আমার স্বপ্নে ভাসে প্রিয় গ্রাম চরকুমারিয়া। আমার সেই বন্ধুরা আজ কোথায়? আজও মনে পড়ে শার্টের বোতাম না লাগিয়ে মেঠোপথে ছুটে বেড়ানোর সময়টাকে।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম