বেহাল ব্রাজিল, কোথায় সেই সুন্দর ফুটবল
ক্রীড়া ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাঁচবারের বিশ্বজয়ী, ফুটবলবিশ্বের অন্যতম সফল দলের খেলা বছরের পর বছর ধরে আনন্দ দিয়ে এসেছে ফুটবলপ্রেমীদের। গোটা বিশ্ব কুর্নিশ করেছে এই ফুটবলকে। মুগ্ধ হয়েছে পেলে, জিকো, সক্রেটিস থেকে রোনালদো, রোনালদিনহোদের খেলা দেখে। সেই ব্রাজিলের সুন্দর ফুটবল হারিয়ে যেতে বসেছে। উরুগুয়ের বিরুদ্ধে কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালে হার ব্রাজিলের ফুটবলের অধঃপতনের আরও একটি উদাহরণ।
শেষ বিশ্বকাপ এসেছে ২২ বছর আগে। শেষ ট্রফি পাঁচ বছর আগে। বড় ট্রফি বলতে সেই ২০১৩ সালে জেতা কনফেডারেশন কাপ, তা-ও ১১ বছর আগে। বছরের পর বছর ধরে ট্রফিখরা, পাশাপাশি মরক্কো, সেনেগালের মতো দলের কাছে হার ব্রাজিলের জন্য লজ্জা। সংকটের এই সময়ে ব্রাজিল দলে এমন একজনকেও দেখা যাচ্ছে না, যিনি ত্রাতা হতে পারেন।
কেন ব্রাজিলের ফুটবলের এই অবস্থা
বেরিয়ে আসছে বেশকিছু কারণ। সেগুলো এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, দ্রুত সমাধান না করলে ব্রাজিলের ফুটবল আরও নিম্নগামী হতে পারে।
তরুণ ফুটবলারদের অর্থের লোভ
গত কয়েক বছর ধরে এই সমস্যাটা হচ্ছে। ব্রাজিলের তরুণ ফুটবলারদের একে একে ছিনিয়ে নিচ্ছে ইউরোপের ক্লাবগুলো। সে দেশের ঘরোয়া লিগে থাকা বিভিন্ন ক্লাবের ‘স্কাউট’রা (যারা প্রতিভাবান ফুটবলার খুঁজে বের করেন) খবর পাঠাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবগুলো অর্থের থলি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তরুণ ফুটবলারদের ওপর। এ ব্যাপারে গত কয়েক বছরে টেক্কা দিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। ব্রাজিল থেকে খুঁজে এনেছে ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো এবং এনদ্রিককে।
ভিনিসিয়ুস ও রদ্রিগো ইতোমধ্যে নিজেদের জায়গা পাকা করেছেন। কিন্তু মাদ্রিদের জার্সি গায়ে পরার আগেই প্রশ্ন উঠেছে এনদ্রিককে নিয়ে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তাকে নিয়ে এত চর্চা হচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল চাঁদে পাড়ি দিয়েছেন। সেই এনদ্রিক সদ্যসমাপ্ত কোপায় উরুগুয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচে সফল পাস দিয়েছেন মাত্র একটি। সেটি হলো খেলা শুরু হওয়ার, অর্থাৎ ‘কিক অফ’-এর পাস। প্রতিভাবান ফুটবলারের যদি এই হাল হয়, তা হলে বাকি দলের কী হাল হতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
সুন্দর ফুটবল থেকে সরে আসা
লাতিন আমেরিকার ফুটবলের ধারক ও বাহক ব্রাজিল। আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ের মতো দল থাকলেও ব্রাজিলের ‘জোগো বোনিতো’ বা সুন্দর ফুটবলের জয়গান হতো সবচেয়ে বেশি। সেই ফুটবল থেকে সরে এসেছে সেলেকাওরা। এর মূল কারণ, ব্রাজিলের বেশির ভাগ ফুটবলার খেলেন ইউরোপের কোনো না কোনো ক্লাবে। সেখানে ফুটবল অনেক বেশি কৌশলগত। ফলে ব্রাজিলের ফুটবলে স্বাভাবিক শিল্প হারাতে বসেছে। অনায়াসে দু-তিনজনকে কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, কিছুই আর চোখে পড়ছে না।
আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি বলেছিলেন, লাতিন আমেরিকার ফুটবল ক্রমশ ‘রোবট’ হয়ে যাচ্ছে। যারা ড্রিবলিং করতে অভ্যস্ত, তারা এখন বল পেলেই পাস করে দিচ্ছেন। আতঙ্কিত স্কালোনি বলেছিলেন, ‘যদি মেসিকে আট বছর বয়স থেকে বলা হতো, পাস করো, ভাবুন আজকের মেসিকে আমরা দেখতে পেতাম কি?’ স্কালোনির মতে, ‘৭-৮ বছর বয়সি ফুটবলারদের নিজেদের মতো খেলতে দেওয়া উচিত। খেলা ঠিক করতে হবে ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে। তা না হলে ফুটবলের সৌন্দর্য হারাবে। দুঃখের বিষয়, ব্রাজিলের খুদে ফুটবলাররাও এখন ইউরোপ বা সৌদি আরবের অর্থের হাতছানি সম্পর্কে অবগত। ফলে ইউরোপীয়রা যেভাবে খেলে, সেই ফুটবল তারা অনুসরণ করছে ছোটবেলা থেকে। ব্রাজিলের নিজস্ব ঘরানা এতে হারাতে বসেছে।’
ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলার গ্রাফাইও বলেছেন, ‘ব্রাজিলের ফুটবলের অতীত ঘরানা এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখন আর তার কোনো অস্তিত্ব নেই।’ ফুটবল ঐতিহাসিক ডেভিড গোমেসের কথায়, ‘ব্রাজিল ফুটবল তার পরিচিতি হারাতে বসেছে।’
ঘরোয়া লিগের খারাপ মান
লাতিন আমেরিকার যে ক্লাব ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে গত পাঁচবার ব্রাজিলের ক্লাব জিতেছে। এমনকি, বিশ্ব ক্লাব কাপেও (পুরোনো ফরম্যাটে) ব্রাজিলের ক্লাবের রেকর্ড ভালো। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগে যে মানের ফুটবল হয়, তার ধারেকাছেও নেই সেই প্রতিযোগিতা। ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলে একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে মাত্র কয়েকটি ক্লাবের। ইউরোপের অনেক ছোট দেশের ক্লাব ফুটবলেও তার চেয়ে ভালোমানের ফুটবল খেলা হয়।
ফুটবল ঐতিহাসিক গোমেস বলেছেন, ‘একবার ভাবুন তো, ইংল্যান্ড বা স্পেনে ব্রাজিলের যে ফুটবলাররা খেলে, তারা নিজেদের দেশে খেললে কেমন হতো? ডগলাস লুইজ, লুকাস পাকুয়েতা, জোয়াও গোমেস, ব্রুনো গিমারায়েস, রিচার্লিসনেরা ব্রাজিলে খেললে এই মহাদেশের ফুটবলের চেহারাই বদলে যেত। কিন্তু আর্থিক প্রলোভন কেউ এড়াতে পারে না।’ গোমেসের মতে, যে প্রথা শুরু হয়েছে তা শেষ করা খুবই কঠিন কাজ। তার কথায়, ‘ব্রাজিলের ক্লাবগুলোর এত বেতন দেওয়ার ক্ষমতা নেই। পাশাপাশি, দেশের প্রতিভা বিদেশে বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থের লোভ তারাও এড়াতে পারে না। ফলে অকালে অনেক প্রতিভা ঝরে যাচ্ছে।’
