রক্ষক যখন ভক্ষক : সাঁতারে যৌন হয়রানি
মোজাম্মেল হক চঞ্চল
প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ক্রীড়াঙ্গনে আবারও আলোচনায় যৌন নিপীড়ন। রাজশাহীর আলমগীর সুইমিং ক্লাবের কোচ আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে নারী সাঁতারুদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে সাঁতার অঙ্গনে। ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে সুইমিং ফেডারেশন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
বুধবার শুরু হওয়া চার দিনব্যাপী বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতা চলকালে আলমগীরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে মিরপুর সুইমিং কমপ্লেক্সের ডরমেটরিতে রাত আনুমানিক ১১টার দিকে এক নারী সাঁতারুর চিৎকার শোনা যায়। আশপাশ থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসা কয়েকজন সাঁতারু ও কর্মকর্তা ছুটে আসেন। সেখানে একটি রুমের সামনে এক নারী সাঁতারুকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পান তারা। ওই নারী সাঁতারু ভয় ও উৎকণ্ঠায় জড়োসড়ো ছিলেন। তার মুখ থেকে যতটুকু শোনা গেছে, তাতে উপস্থিত সবাই নিশ্চিত হয়েছেন আলমগীর হোসেন এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন। আরেকটি সূত্র দাবি করেছে, তাৎক্ষণিকভাবে নির্যাতিতাকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন আলমগীর। ওই নারী সাঁতারুর সাক্ষ্যপ্রমাণের অডিও এসেছে যুগান্তরের হাতে। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, রাজশাহীর চরে ছেলে ও মেয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে যেতেন কোচ আলমগীর। সেখানে ছেলেদের প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে নিজ হাতে মেয়েদের সুইমিং কস্টিউম পড়ানোর চেষ্টা করতেন এই কোচ। শুধু তাই নয়, মেয়েদের গায়েও হাত দিতেন।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক প্রচার হয়। শুক্রবার সুইমিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শাহীনের কাছে এক নারী সাঁতারু অভিযোগ দেন। পরবর্তীতে শনিবার আলমগীর সুইমিং ক্লাবের সাঁতারুরা সাধারণ সম্পাদকের কাছে লিখিত দেন। চিঠিতে বলা হয়, ‘আলমগীর হোসেন মিয়া আমাদের সাঁতার কোচ। কিন্তু কোচিং করানোর সময় বডি ম্যাসাজ করার কথা বলে কয়েক বছর ধরে সাঁতারুদের সঙ্গে অনৈতিক কাজ করে আসছেন। এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বলার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন। এর আগেও একাধিক সাঁতারুর সঙ্গে অনৈতিক কাজের বিষয়টি ফাঁস হলেও সম্মানের কথা বিবেচনা করে তাদের পরিবার কোনো কথা বলত না এবং তাদের মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিত। যারা তার অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হয়, তাদের নামে বিভিন্নভাবে বদনাম ছড়িয়ে দিতেন। এর আগে এক নারী সাঁতারুকে শ্লীলতাহানি ঘটালে তা জানাজানি হয় এবং বিয়ে করতে বাধ্য হয় আলমগীর। নারী নির্যাতন নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা এখনো চলমান। দুই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে এখনো তিনি নারী সাঁতারুদের যৌন নিপীড়ন করে চলেছেন। পারিবারিক সম্মানহানির ভয়ে আমরা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। কিন্তু আমরা চাই সাঁতারুরা নিরাপদে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুক। তাই আলমগীর হোসেন মিয়াকে আজীবন নিষিদ্ধ করে আমাদের মতো সাঁতারুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ করছি।’ অভিযোগ পেয়ে ফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষ মেজর (অব.) আতিকুল ইসলাম, সিইও সালাহউদ্দিন আহমেদ ও সদস্য নিলু আফরোজের সমন্বয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সুইমিং ফেডারেশন। সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শাহীন যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘মাত্র তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। কমিটি দুয়েকদিনের মধ্যেই সভা করে তদন্ত কাজ শুরু করবে বলে আশা করছি।’ অন্যদিকে আলমগীর হোসেনের দাবি, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। ফেডারেশনের একটি গ্রুপ ঈর্ষান্বিত হয়ে এই কাজ করছে।
এর আগেও সাঁতারে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। অনুরূপ নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে ২০০৯ সালে আত্মহত্যা করেছিল এক মহিলা সাঁতারু। ২০০৯ সালে জুনিয়র সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে পাঁচটি স্বর্ণ জেতে আরিফা খাতুন। কুষ্টিয়ার এই সাঁতারু সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেয় আনসারে। এরপর দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এই কিশোরীর জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। সাঁতারে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিজের বাড়িতে বিষপানে আত্মহত্যা করে ১৫ বছর বয়সি এই সাঁতারু। সুরতহাল ছাড়াই তার মরদেহ দাফন করা হয় তড়িঘড়ি করে। তার সতীর্থদের অভিযোগ ছিল, গর্ভবতী হওয়ার কারণে দুর্ভাগা সাঁতারু নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছিল। অভিযোগের তির যায় আনসারের কোচ এমদাদুল হকের দিকে। তার বিরুদ্ধে আনসার তদন্ত করে এবং নানা প্রমাণের ভিত্তিতে এই সাঁতার কোচকে নিষিদ্ধ করে। এ রকম নানা অভিযোগে সাঁতারের দুই কোচ আমীরুল ইসলাম ও গোলাম মোস্তফাকে নিষিদ্ধ করেছিল সাঁতার ফেডারেশন।
ক্রীড়াঙ্গনে নারী ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে যৌন নিপীড়ন বা যৌন হয়রানি নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও নানা সময়ে নানা কারণে এমন অনৈতিকতার শিকার হয়েছেন অনেক অসহায় নারী ক্রীড়াবিদ। বছরকয়েক আগে ভারোত্তোলনে এক নারী ভারোত্তোলককে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন অফিস সহকারী মো. সোহাগ মিয়া। যদিও কদিন আটক থাকার পর বের হয়ে আসেন সোহাগ। অফিস সহকারী থেকে এখন রীতিমতো ভারোত্তোলক বনে গেছেন সোহাগ। ক্রীড়াঙ্গনে যৌন নিপীড়নের সবশেষ ঘটনা ছিল জুজুৎসুতে। দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে চাকরির লোভ দেখিয়ে এক তরুণীকে ধর্ষণ করেন বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম নিউটন। রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অ্যাসোসিয়শনের অধিকাংশ প্রশিক্ষণার্থী নারী। অভিভাবক হিসাবে এই কোমলমতি মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল তার। কিন্তু এই ব্যক্তি কোমলমতি মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস চালান। নিউটন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের মতো পদে থেকে প্রশিক্ষণার্থীদের ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া এবং বিদেশ ভ্রমণের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের মতো অপকর্ম করতেন। অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে গর্ভবতী হলে তাদের গর্ভপাত করানোর মতো ভয়ংকর কাজও করেছেন। এমনকি অনুশীলনের আগে মেয়েদের পোশাক পরিবর্তনের কক্ষে প্রবেশ করে তাদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করে ভিডিও ধারণ ও নগ্ন ছবি তুলে রাখতেন। পরবর্তীতে নগ্ন ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে বারবার ধর্ষণ করতেন। পরে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। যদিও ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জেলহাজত থেকে ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছেন নিউটনও। বর্তমানে ওই ধর্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করে নিউটন সংসার করছেন বলেও জানা গেছে।
ব্যাডমিন্টনে এমন নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল ব্যাডমিন্টনের কর্মকর্তা জাহিদুল হক কচির বিরুদ্ধে। খেলাটির সঙ্গে তার নাড়ির যোগ থাকায় জীবনটাও কেমন নারীময় হয়ে গেল। ব্যাডমিন্টনের কিছু মেয়ে খেলোয়াড়কে তার বাসায় রাখা, দেখভাল করা এবং ট্রেনিং করানো-এসবই নিয়ে তিনি আলোচিত-সমালোচিত। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে নারী বিদ্রোহেই তার সেই মুকুট খসে পড়ার দশা! নাবিলা আক্তার নামের এক ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় কচির বিরুদ্ধে তুলেছিলেন যৌন হয়রানির অভিযোগ। কচি তখন ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। মেয়েটি সজল নয়নে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে অভিযোগের ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন। এক শাটলারকে দামি কাপড় কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ রকমই ছিল ওই শাটলারের অভিযোগনামা। এরপর নয়জন মহিলা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় স্বাক্ষর করে লিখিত অভিযোগ দেন ফেডারেশনের কাছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোচের পদ থেকে কচিকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন খেলোয়াড়রা।
নারীঘটিত অভিযোগে টেনিস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোর্শেদকে বহিষ্কার করেছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রবাসী এক কিশোরী টেনিস খেলোয়াড়কে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। গুলশান থানায় মামলাও হয় তার বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী খেলোয়াড় ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাবেক এক তারকা টেনিস খেলোয়াড়ের মেয়ে। দেশে একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে এসে যৌন হয়রানির শিকার হন তিনি। তার পক্ষে তার চাচা সাবেক টেনিস খেলোয়াড় হীরা লাল গুলশান থানায় এ মামলা করেছিলেন।
শুটিংয়েও কোচের হাতে এক নারী শুটারের লাঞ্ছনার করুণ কাহিনি আছে। মেয়ে শুটারদের যৌন হরয়ানি করার প্রমাণ রয়েছে এক সিনিয়র শুটারের বিরুদ্ধে। ওই শুটার বিভিন্ন অপকর্মে কয়েক দফা জেলও খেটেছেন।
কাবাডি ফেডারেশনে এক সাবেক সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন তার স্ত্রী। কারণ এক নারী খেলোয়াড়কে নিয়ে মেতে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক স্বয়ং। এখানেই খেলাটির সাড়ে সর্বনাশ!
