দাবার চাকা ঘুরছে না কে দেবে টাকা!
পারভেজ আলম চৌধুরী
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার বাংলাদেশের নিয়াজ মোরশেদ। ৩৮ বছর আগে তার হাত ধরে দাবায় শিখরস্পর্শী সফলতা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এক বছর পর ১৯৮৮ সালে ভারত তাদের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার পায় বিশ্বনাথন আনন্দের মাধ্যমে। আনন্দ পরে পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন এবং ভারতীয় দাবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটান। ২০২৫-এ এসে ভারতের গ্র্যান্ডমাস্টার ৮৯ জন। দুই মাসের ব্যবধানে দুজন গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছে তারা। জুলাইয়ে দিব্যা দেশমুখ এবং এ মাসে রোহিত কৃষ্ণা। বাংলাদেশ থমকে আছে সেই পাঁচজনেই। এর মধ্যে পঞ্চম ও শেষ গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব জিএম নর্ম পেয়েছিলেন ২০০৮ সালে। পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের মধ্যে জিয়াউর রহমান না ফেরার দেশে চলে গেছেন গত বছর। আবদুল্লাহ আল রাকিব দাবা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। এনামুল পাড়ি জমিয়েছেন ইংল্যান্ডে। রিফাত বিন সাত্তার পুরোদস্তুর চাকুরে। তবে নিয়াজ নিজেকে এখন ‘শৌখিন দাবাড়ু’ বলতে কৌতুক বোধ করেন।
দাবায় কেন এই উলটোযাত্রা, ষষ্ঠ জিএম না পাওয়া-দাবাসংশ্লিষ্টরা প্রায় কোরাস কণ্ঠে মূল সমস্যা হিসাবে অর্থনৈতিক সংকটের কথা তুলে ধরেন। টাকা নেই, তাই ঘুরছে না দাবার চাকা। দেশে-বিদেশে প্রচুর টুর্নামেন্ট খেলতে হবে, বহুল চর্চিত এমন কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতাশূন্য দাবাকে পথ দেখানোর পথপ্রদর্শকই যে নেই। অর্থাভাবে কাজাখস্তানে ফিদে বিশ্ব ক্যাডেট দাবায় অংশ নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল সিদরাতুল মুনতাহার। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহায়তায় সমস্যার সুরাহা হয়।
দাবা অন্তঃপ্রাণ মো. হারুন অর রশিদ, যিনি খেলাটির আন্তর্জাতিক বিচারক, অর্থসংকটের পাশাপাশি ‘দাবার সংস্কৃতি’ গড়ে না ওঠাটাকেও পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন। তার আশা, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে দাবা-অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। তার মতে, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যে পাঁচজন গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছে, তাদের এতদূর আসার পেছনে পরিবারের সমর্থন ও সহযোগিতা রয়েছে।
এদিকে দাবায় বাংলাদেশের ‘বাতিঘর’ নিয়াজ মোরশেদ মনে করেন, ‘পৃষ্ঠপোষক সেখানেই আসবে, যেখানে আশার আলো থাকবে। অনেকদিনের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের। সঠিক পথে যদি দাবা থাকত, তাহলেও উন্নতি করতে নিদেনপক্ষে পাঁচ বছর লাগত। এখন তো আরও বেশি সময় লাগবে।’ নিয়াজ এজন্য সীমিত সম্পদ দিয়ে ধৈর্য ধরে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান। দাবা তারুণ্যের খেলা-একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার বলেন, ‘সত্যি বলতে, দাবা হচ্ছে তরুণদের খেলা। আমি যখন ২০২১ সালে দাবা বিশ্বকাপে খেলতে যাই, সেবার ওই আসরের তৃতীয় বয়োজ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় ছিলাম।’
নিয়াজের যুক্তি অকাট্য। দাবায় বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের গুকেশ দোমারাজু ২০২৪ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে এই কীর্তি গড়েন। এ বছর ফিদে নারী বিশ্বকাপের মুকুট মাথায় উঠেছে ভারতের দিব্যা দেশমুখের। তার বয়স ১৯। এই অর্জন তাকে ভারতের ৮৮তম গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব এনে দিয়েছে। সদ্য ফিদে মাস্টারের নর্ম পাওয়া বাংলাদেশের ওয়ারসিয়া খুশবুকে আন্তর্জাতিক মাস্টার হতে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। গত বছর আন্তর্জাতিক মাস্টারের নর্ম অর্জন করা মনন রেজা নীড়ও তাকিয়ে স্পন্সরের দিকে। একই কথা প্রযোজ্য দীর্ঘদিন গ্র্যান্ডমাস্টারের নর্ম পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা মোহাম্মদ ফাহাদ রহমানের বেলায়ও।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কিংবদন্তি মার্কিন দাবাড়ু ববি ফিশার বলেছিলেন, ‘জীবনে আমার একটাই কাজ, শুধুই দাবা খেলে যাওয়া।’ ফাহাদ-মনন, ওয়ারসিয়া-সিদরাতুলরা বছরভর শুধু দাবামগ্ন থাকবেন, সেই ব্যবস্থা করে দেওয়ার সামর্থ্য কিংবা সদিচ্ছা দাবা ফেডারেশনের আছে কি না, এ এক বিরাট প্রশ্ন।
