ভূমিকম্পে করণীয় ও বর্জনীয়
ডা. এম এ হালিম খান
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভূমিকম্প পৃথিবীর অন্যতম বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের কম্পনেই ধসে যেতে পারে বহু স্থাপনা, ভেঙে পড়তে পারে সেতু, রাস্তা, ভবন, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দৈনন্দিন জীবন আর সবচেয়ে বড় আশঙ্কা প্রাণহানি। ভূমিকম্প কখন, কোথায়, কোন মাত্রায় আঘাত হানবে তা আজও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভুলভাবে জানাতে পারে না। তাই ক্ষতি কমানোর একমাত্র উপায় হলো সচেতনতা, প্রস্তুতি ও সঠিক মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা। নিচে ভূমিকম্পের আগে, ভূমিকম্পের সময় ও ভূমিকম্পের পর করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো।
* ভূমিকম্পের আগে প্রস্তুতি : নিরাপত্তার প্রথম ধাপ
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পূর্বপ্রস্তুতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ঘরবাড়ি, অফিস, স্কুল বা যে কোনো ভবনে এমন কিছু ব্যবস্থা থাকা উচিত যা কম্পন শুরু হলে আঘাতের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।
প্রথমত, পরিবারের সব সদস্যকে জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা জরুরি। শিশু, বৃদ্ধ, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী পরিবারের সদস্যদের আলাদা করে প্রস্তুত করতে হবে। ঘরের ভেতর ভারী আলমারি, শোকেস, বুকশেলফ, ফ্রিজ বা টিভি সব দেওয়ালে পেরেক বা ব্র্যাকেট দিয়ে শক্ত করে বাঁধা থাকা উচিত। কারণ ভূমিকম্পে এসব ভারী জিনিস উলটে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
রান্নাঘরের ওপরের তাকগুলোতে কাচের বাসন বা বোতল রাখলে কম্পনে সেগুলো পড়ে ভেঙে যেতে পারে, তাই নিচের স্তরে ভঙ্গুর জিনিস রাখা উত্তম। জরুরি বহির্গমন পথ খোলা ও অবরুদ্ধহীন থাকা চাই। ঘরে একটি জরুরি ব্যাগ রাখা যেতে পারে যেখানে টর্চলাইট, ব্যাটারি, প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম, পানি এবং কিছু শুকনা খাবার থাকবে।
* ভূমিকম্পের সময় করণীয় : কয়েক সেকেন্ডেই সিদ্ধান্ত
ভূমিকম্প শুরু হলে মানুষের প্রথম প্রতিক্রিয়া সাধারণত আতঙ্ক। কিন্তু আতঙ্কই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার উৎস। তাই শান্ত থাকা এবং নিয়ম অনুযায়ী আচরণ করা জীবন রক্ষার প্রধান উপায়। সবচেয়ে কার্যকর নিরাপত্তা পদ্ধতি হলো ‘Drop-Cover- Hold’
▶ Drop : প্রথম কম্পন অনুভব করতেই দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধ করে মাটিতে বসে পড়ুন।
▶ Cover : মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত আসবাবের নিচে আশ্রয় নিন।
▶ Hold : টেবিল/ডেস্ক শক্ত করে ধরে থাকুন যেন নড়ে গেলেও আশ্রয় না সরে যায়।
* ঘরের ভেতরে থাকলে
▶ দরজা, জানালা বা কাচের কাছ থেকে সরে আসুন।
▶ ভারী আলমারি, ফ্রিজ, পাখা বা লাইটের নিচে যাবেন না।
▶ এলিভেটর ব্যবহার করা কঠোরভাবে নিষেধ কারণ কম্পনে লিফট আটকে যেতে পারে।
▶ রান্নাঘরে থাকলে চুলা থেকে দূরে সরে যান এবং গ্যাস বন্ধ করার চেষ্টা করবেন না, কম্পন থামার পরই তা করুন।
▶ দরজার ফ্রেমে দাঁড়ানোর প্রচলিত ধারণা আর নিরাপদ নয়, তাই সেখানে না দাঁড়ানোই ভালো।
* বাইরে থাকলে
▶ ভবন, বৈদ্যুতিক খুঁটি, সেতু, গাছ বা সাইনবোর্ড থেকে দূরে চলে যান।
▶ খোলা জায়গায় বসে মাথা ঢেকে রাখুন।
▶ রাস্তা দিয়ে গাড়ি চললে ধীরে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করুন, কিন্তু সেতু বা ওভারপাসের নিচে থামবেন না।
* ভিড়ের মধ্যে থাকলে
▶ হুড়োহুড়ি বা দৌড়াদৌড়ি করা বিপজ্জনক।
▶ আশপাশে ঠেলে-ধাক্কা সৃষ্টি হতে দেবেন না।
▶ বসে পড়ে মাথা-ঘাড় হাত দিয়ে ঢেকে রাখুন।
* ভূমিকম্পের সময় বর্জনীয় : ভুল সিদ্ধান্তই বড় বিপদ
ভূমিকম্পে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে আতঙ্ক, ভুল ধারণা ও দৌড়াদৌড়ির কারণে। তাই কিছু বিষয় কখনোই করা যাবে না।
▶ কখনোই লিফট ব্যবহার করা যাবে না।
▶ জানালা, কাচ ও ভঙ্গুর বস্তু থেকে দূরে থাকতে হবে।
▶ দৌড়ে ভবনের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করা বিপজ্জনক কারণ বাইরে যাওয়ার পথে বা সিঁড়িতে ধসের ঝুঁকি বেশি।
▶ মোমবাতি বা আগুন জ্বালাবেন না, গ্যাস লিকেজের আশঙ্কা থাকলে আগুন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
▶ ভারী আসবাবের নিচে লুকিয়ে ভুল করবেন না এসব সহজেই ভেঙে পড়তে পারে।
* ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পর করণীয় : দ্বিতীয় ধাপের নিরাপত্তা
কম্পন থেমে যাওয়ার পরও বিপদের পুরোপুরি সমাপ্তি হয় না। আফটারশক যে কোনো সময় হতে পারে, যা মূল ভূমিকম্পের মতোই বিপজ্জনক। তাই পরবর্তী করণীয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমে ভবনের ক্ষয়ক্ষতি পরীক্ষা করতে হবে। দেওয়ালে বড় ফাটল, খসে পড়া অংশ, বা বিম-কলামে সমস্যা দেখা গেলে ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না। ঘরের গ্যাস সংযোগ, পানির লাইন ও বিদ্যুতের সুইচ পরীক্ষা করে দেখুন। গ্যাস লিকের গন্ধ পেলে দ্রুত জানালা খুলে দিন এবং ম্যাচ/চুলা জ্বালাবেন না।
আশপাশে কেউ আহত থাকলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিন এবং গুরুতর হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠান। জরুরি নম্বরগুলো হাতের কাছে রাখুন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে নির্ধারিত নিরাপদ স্থানে সবাই জড়ো হতে হবে।
সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন বা মোবাইলে পাওয়া আপডেট অনুসারে নিরাপদে চলাচল করতে হবে। ভূমিকম্পের পর গুজব ছড়ানো বা যাচাই-বাছাই ছাড়া তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
* সচেতনতা ও প্রস্তুতিই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা
ভূমিকম্প একটি অপ্রতিরোধ্য দুর্যোগ। কিন্তু বিশ্বজুড়ে গবেষণা ও অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত সঠিক শিক্ষা, নিয়মিত মহড়া এবং সচেতনতা প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে পারে। স্কুল, কলেজ, অফিস সব জায়গায় বছরে অন্তত একবার ভূমিকম্প মহড়া থাকা উচিত। পরিবারে শিশুদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করে তাদের প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন।
কিছু সহজ নিয়ম যেমন-Drop-Cover-Hold পদ্ধতি জানা, আতঙ্ক না করা, নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া একটি সংকটময় মুহূর্তে জীবন বাঁচাতে পারে।
মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির শক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও, আমাদের প্রস্তুতি ও সচেতনতা সম্পূর্ণ আমাদের হাতের মধ্যেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
