Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

বাত-ব্যথায় কী করবেন

Icon

ডা. ইকবাল আহমদ চৌধুরী

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাত-ব্যথায় কী করবেন

ছবি: সংগৃহীত

বাতরোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মেডিসিনের একটি বিশেষায়িত শাখা। সারা বিশ্বে এটা রিউমেটোলজি হিসাবে পরিচিত। এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের রিউমেটোলজিষ্ট বলা হয়। রিউমেটোলজি হাড় জোড়া (জয়েন্ট), জয়েন্টের সঙ্গে সম্পর্কিত অংশ (Ligament, Tendon), মাংসপেশি ও রক্তনালির প্রদাহজনিত রোগ নিয়ে কাজ করে ও এর সঠিক চিকিৎসা প্রদান করে।

* প্রদাহজনিত বাতরোগ

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রদাহজনিত বাতরোগ। এ রোগে দ্রুত রিউমেটোলজিস্টের কাছে চিকিৎসা না করালে জয়েন্ট সারা জীবনের জন্য অকেজো বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, রক্তনালি, মস্তিষ্ক, কিডনি, চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে এসব রোগ ছড়িয়ে পড়ে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।

* লক্ষণ

জয়েন্ট বা গিরা ব্যথা, ফুলে যাওয়া, শেষ রাতে বা ভোর বেলা এ ব্যথা বেড়ে যায়। ঘুম হতে ওঠার পর আধা ঘণ্টা হতে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত তীব্র ব্যথা থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে ব্যথা কমতে থাকে, জয়েন্ট ব্যথা ছাড়াও মেরুদণ্ডে (কোমর-ঘাড়-পিঠ) ব্যথা হয়, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, মুখে দীর্ঘস্থায়ী ঘা, নাকের দুই পাশে প্রজাপতির মতো লাল দাগ যা রোদে গেলে তীব্র হয়। এ ছাড়া শরীরের অন্য জায়গায় লালচে দাগ-ঘা হতে পারে। চোখ লাল হয়, ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, হার্টে পানি জমা ও বাল্বে সমস্যা, কিডনি সমস্যা (শরীর ফুলে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া) মস্তিষ্ক সমস্যা (খিঁচুনি, মাথাব্যথা, প্যারালাইসিস) হতে পারে। ডায়রিয়া, রক্ত আমাশয় বা অবৈধ যৌন মিলনের কয়েকদিন পর জয়েন্ট ব্যথাসহ চোখ লাল হওয়া ও হাত-পা-তালুতে ও পুরুষাঙ্গে ঘা। এসব রোগের মধ্যে আছে রিউমাটোয়েড আর্থাইটিস, SLE, স্পন্ডিলো আর্থপ্যাথি (SpA-এনকাইলজিং স্পন্ডিলাইটিস, রিঅ্যাক্টিব ও সরিয়াটিক আর্থাইটিস), মায়োসাইটিস, ভাসকুলাইটিস, গাউট ইত্যাদি।

* চিকিৎসা

রোগীর লিভার, কিডনি, রক্ত রোগ আছে কিনা, জীবাণু আক্তান্ত কিনা (ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া, যক্ষ্মা), সন্তান নিতে ইচ্ছুক কিনা এসব বিষয় যাচাই করে ওষুধ নির্ধারণ করতে হয়। ওষুধ শুরুর আগে প্রয়োজনীয় কয়েকটি টিকা (নিউমোনিয়া, হেপাটাইটিস-বি, ইনফ্লুয়েঞ্জা) দিতে হয়। ওষুধ শুরুর পর প্রথমে কয়েক মাস রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। কারণ, যেসব ওষুধ দেওয়া হয় তাতে লিভার, কিডনি সমস্যা, রক্তস্বল্পতা, জীবাণু আক্রমণ হতে পারে। রোগীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে কিনা তাও প্রতি মাসে যাচাই করতে হয়। ওষুধের মারাত্বক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ওষুধের মাত্রা কমানো বা বন্ধ রাখতে হয় ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চিকিৎসা দিতে হয়। প্রথম স্তরের ওষুধে কাজ না করলে, ২য় স্তরের, প্রয়োজনে ৩য় স্তরের ওষুধ শুরু করতে হয়।

* হাড়ের ক্ষয় বা ভঙ্গুরতা রোগ (Osteoporosis) : বয়স্কদের বিশেষ করে ৫০ বছরের বেশি বয়সের মহিলাদের অথবা অল্প বয়সে যাদের জরায়ু অপারেশন করা হয়, বা মাসিক বন্ধ হয়ে যায় তাদের এ রোগ হয়। এ রোগে হাড়ের ক্যালসিয়াম কমে যায় এবং হাড় সামান্য আঘাতে, এমনকি আঘাত ছাড়াই ভেঙে যায়, বিশেষ করে মেরুদণ্ড ও ঊরুর ওপরের হাড়। সেজন্য বয়স্ক রোগীদের হাড় ভাঙা প্রতিরোধকারী ওষুধ (বিসফসফোনেট) দিতে হয়। অনেকে না জেনে হাঁটু ব্যথা, কোমর ব্যথা, শরীর ব্যথা এমনকি অল্প বয়সি রোগীদের BMD পরীক্ষা ছাড়াই এ ওষুধ ৩-৬ মাস ব্যবহার করতে দেন। এ ওষুধ হাঁটু, কোমর বা শরীর ব্যথা কমায় না। হাড় ভেঙে যাওয়ার আগে এ রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। ব্যবহারের আগে অবশ্যই BMD পরীক্ষা করে T Score-2.5 হলেই এ ওষুধ দিতে হবে। এ রোগে মুখে খাওয়ার ওষুধ যেমন-Salost, Sedron, Ostel, Bone Mass কমপক্ষে ৫ বছর, ইনজেকশন (Zolenic, Zandra, Zoltero, Bonizol) কমপক্ষে ৩ বছর নিতে হবে। অনেকে না জেনে এ রোগে Ibandronic Acid (Bonova/Calorate Kit/Bondrova/Bone Guard, Maxbone) ব্যবহার করেন। এ ওষুধটি অন্য জায়গায় কাজ করলেও ঊরুর হাড় ভাঙা প্রতিরোধে কাজ করে না। সেজন্য এমন ওষুধ নির্বাচন করা উচিত যা শরীরের সব জায়গায় কাজ করে।

* আঘাত ও দুর্ঘটনাজনিত ব্যথা

আঘাত, দুর্ঘটনা বা পড়ে গিয়ে হাড়

জোড়া যদি ভেঙে যায় অথবা লিগামেন্ট, রগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে অবশ্যই অর্থপেডিক সার্জনের পরামর্শ নেবেন। এ ছাড়া বয়সজনিত হাঁটু ব্যথায় জয়েন্ট অত্যধিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওষুধ, ফিজিওথেরাপি কোনো কাজে না এলে হাঁটুতে অপারেশন করতেও হাড় জোড়া বিশেষজ্ঞ বা অর্থপেডিক সার্জনের কাছে যাবেন।

* বয়সজনিত জয়েন্ট রোগ

এতে জয়েন্টের কিছু জায়গায় হাড়ে ক্ষয় হয় ও কিছু জায়গায় অস্বাভাবিক নতুন হাড় তৈরি হয়। এসব রোগে হাঁটু, কোমর ও ঘাড়ে ব্যথা হয়, হাঁটু ভাজ করে, সামনে ঝুঁকে কাজ করতে, ঘাড় ঘোরাতে কষ্ট হয়। বিশ্রাম নিলে ব্যথা কমে। এসব রোগের সঠিক চিকিৎসা আজও আবিষ্কৃত হয়নি। কিছু নিয়ম কানুন, নির্দিষ্ট ব্যয়াম, সাধারণ ব্যথানাশক ওষুধ, প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি নিলে ব্যথা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকে। অনেকে না বুঝে এসব রোগে ক্যালসিয়াম খান, কিন্তু বয়সজনিত হাঁটু, কোমর ও ঘাড় ব্যথায় ক্যালসিয়াম কোনো কাজ করে না। এ রোগে স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ, দীর্ঘদিন ব্যথানাশক NSAIDs জাতীয় ওষুধ, হাঁটুতে প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে ইনজেকশন নেওয়া মারাত্মক ক্ষতিকর। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে ১টি হাঁটুতে ৩-৪ মাস পরপর বছরে সর্বোচ্চ ৩টি ইনজেকশন দেওয়া যায়।

* বাতরোগে ভুল চিকিৎসা

অনভিজ্ঞ চিকিৎসক বা হাতুড়ে চিকিৎসকরা না জেনে অনেক সময় ভুল চিকিৎসা করে রোগীর জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করতে পারে। একসঙ্গে একাধিক NSAIDs জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। অনেকে না জেনে একই সঙ্গে Ketorolac ইনজেকশন, Voltalin সাপোজিটরি ও মুখে খাওয়ার জন্য নেপ্রোসিন দেন। এতে রোগীর কিডনি নষ্ট হতে পারে। বাত-ব্যথার কারণ বা রোগ নির্ণয় না করে বা প্রদাহজনিত রোগ ছাড়া স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ (Cortan, Deltasone, Deflacort, Predixa, Refla, Xalcort, Flacort, Methipred, Solupred) বা এ জাতীয় ওষুধ খেলে বা হাঁটুতে স্টেরয়েড ইনজেকশন নিলে, খুব দ্রুত আপাতত ব্যথা কমলেও ভবিষ্যতে মারাত্মক শারীরিক সমস্যা যেমন-ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হাড়ের ক্ষয়রোগ ও হাড় ভেঙে যেতে পারে এবং অন্ধত্বসহ অনেক রোগ হতে পারে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন ও বাত-ব্যথা (রিউমেটোলজি) বিশেষজ্ঞ, ইবনে সিনা হাসপাতাল, সুবহানীঘাট, সিলেট।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম