কাশি মানেই শিশুর অসুস্থতা নয়
অধ্যাপক ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শ্বাসতন্ত্র থেকে শ্লেষ্মা, অস্বস্তিকর পদার্থ এবং সংক্রামক জীবাণু বের করে দিয়ে কাশি প্রকৃতপক্ষে শরীরের রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এর ফলে শ্বাসতন্ত্রে শ্লেষ্মা এবং অন্যান্য তরল জমতে পারে না। শ্বাসতন্ত্রের যত উপসর্গের জন্য মানুষ ডাক্তারের কাছে যায়, তার মধ্যে কাশি এক নম্বর। কাশি হওয়া মানেই যে আপনার সন্তান অসুস্থ, এ কথা সব সময় সত্য নয়। স্বাভাবিক শিশুরাও দিনে ১ থেকে ৩৪ বার কাশতে পারে এবং এ কাশির পালা চলতে পারে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত। রাতে ঘুমের মধ্যে কাশি হলে তাকে সবসময়ই অস্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করতে হবে। তখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।
শিশু এবং বড়দের কাশি ও চিকিৎসার মধ্যে যেমন কিছু সাদৃশ্য আছে, তেমনই কিছু বৈসাদৃশ্যও রয়েছে। শিশুদের কাশি দুই রকম হতে পারে। একিউট কাশি (মেয়াদকাল এক থেকে দুই সপ্তাহ) এবং ক্রনিক কাশি (মেয়াদকাল চার সপ্তাহের বেশি)।
বাচ্চাদের একিউট কাশি : প্রধান কারণ হচ্ছে শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ। বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস এ কাশির জন্য দায়ী হতে পারে। প্রাকস্কুল বয়সের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শিশু বছরে ছয় থেকে আটবার ভাইরাসজনিত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে। এগুলো সচরাচর প্রত্যক্ষ বায়ুবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ। এছাড়া পোস্টনাজ্যাল ড্রিপ নামক একটি প্রক্রিয়াতেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় শ্লেষ্মা বিন্দুগুলো নাক এবং সাইনাস থেকে ধীরে ধীরে গলার দিকে চলে যায়। এ সংক্রমণে বেশিরভাগ সময়েই ওষুধের প্রয়োজন হয় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ডাক্তারের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভালো।
ক্রনিক কাশি : ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী কাশি (চার সপ্তাহের অধিক সময়ব্যাপী) শিশুদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। এ ধরনের কাশির কারণগুলো হচ্ছে-
অ্যাজমা ও হাঁপানির উপসর্গ হিসেবে কাশি : অ্যাজমা আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে কাশি হচ্ছে প্রধানত উপসর্গ (সঙ্গে থাকে বুকের মধ্যে শন শন শব্দ এবং ছোট ছোট শ্বাস) কোনে কোনো শিশুর ক্ষেত্রে পিতা-মাতা উপসর্গ হিসেবে শুধু কাশিকেই খেয়াল করতে পারেন। শিশুদের অ্যাজমার ক্ষেত্রে কাশিই হচ্ছে প্রধান উপসর্গ। অ্যাজমাজনিত কাশির প্রকোপ বেড়ে যায় ভাইরাস সংক্রমণের কারণে, বিশেষ করে রাতে। খেলাধুলা এবং ঠাণ্ডা বাতাস কাশিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। অ্যাজমাজনিত এ কাশির চিকিৎসায় শিশুদের ক্ষেত্রে বড়দের মতোই ইনহেলার ও মুখে খাওয়ার ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
নাক এবং সাইনাসের অসুখের কারণে কাশি : রাইনাইটিস (নাকের প্রদাহ) ও সাইনুসাইটিস (সাইনাসের প্রদাহ) শিশুদের পোস্টনাজ্যাল ড্রিপের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। ফলে দীর্ঘস্থায়ী কাশি হতে পারে। নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া বা সর্দি ঝরা থাকলেও এক্ষেত্রে মূল উপসর্গ হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায় কাশিই। এ রোগের আরেকটি কারণ হচ্ছে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস (ই-ফিভার)। এটি মৌসুমী হতে পারে। হতে পারে সাংবাৎসরিকও। এক্ষেত্রে অ্যালার্জি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। সাইনাসের সংক্রমণের কারণে যে কাশি হয় তা সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাসাধিককাল ধরেও চলতে পারে। সাইনাসের এক্সরে বা সিটিস্ক্যানের প্রয়োজন হতে পারে রোগ নির্ণয়ের জন্য।
পাকস্থলী এবং খাদ্যনালির রোগজনিত কাশি : কিছু শিশুর ক্ষেত্রে ক্রনিক কাশির কারণ হিসেবে পাকস্থলী এবং খাদ্যনালি সংক্রমণকে খুঁজে পাওয়া যায়। গ্যাস্ট্রো-ইসোফেসিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিস হচ্ছে সবচেয়ে সাধারণ। এ অসুখের সঙ্গে বুকজ্বালা থাকে। শিশুরা বুকজ্বালার কথা তেমন বলতে পারে না। সম্ভবত তারা বুঝতে পারে না যে এটি একটি রোগের লক্ষণ। এমনও হতে পারে যে তারা এ কষ্টের অনুভূতিকে ঠিকমতো ব্যক্ত করতেও শেখেনি। অনেক শিশুর ক্ষেত্রে কাশির সঙ্গে বুকজ্বালা থাকে না। কারণ কারও গলার স্বর কর্কশ হয়ে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি ট্রায়াল হিসেবে ডাক্তার শিশুকে কাশির ওষুধও দিতে পারেন। খেতে বসে ঢেঁকুর তোলা বা খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়ার কারণে কাশির উদ্রেক হওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণ ঘটনা।
দীর্ঘস্থায়ী কাশির অন্যান্য কারণ : ভাইরাস সংক্রমণ পরবর্তী কাশি- ভাইরাসের কারণে শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি হলে কয়েক সপ্তাহব্যাপী কাশি হতে পারে। শিশুর অ্যাজমা, অ্যালার্জি বা সাইনুসাইটিস না থাকলেও এমনটি ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। অনেক সময় আপনাতেই কাশি সেরে যায়। কফ সিরাপ ব্যবহার করলে অনেক সময় সুফল পাওয়া যায়।
নাকে কোনো জিনিসের প্রবেশ : প্লাস্টিকের খেলনার ক্ষুদ্র অংশ, বাদাম, হটডগ বা শক্ত চকোলেটের অংশ দুই থেকে চার বছরের শিশুদের নাকে গলায় আটকে যাওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি থাকে। অনেক সময় এক্সরেতেও এসব জিনিস ধরা পড়ে না। এগুলো অপসারণ না করা পর্যন্ত শিশুর কাশি ভালো হয় না।
অভ্যাসের কাশি : এ ধরনের দীর্ঘস্থায়ী কাশির কোনো সুনির্দিষ্ট শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। শিশু-কিশোর এবং সদ্য তরুণদের মধ্যে এ ধরনের কাশি দেখা যায়। শুরু হয় সচরাচর ভাইরাসের সংক্রমণ দিয়ে। কাশির ধরন শুকনো এবং নির্দিষ্ট বিরতিতে কাশির উদ্রেক। আক্রান্ত শিশুর চেয়ে পিতা-মাতা বা শিক্ষকরাই কাশির ঠা ঠা শব্দ শুনে আতঙ্কিত হয়ে থাকেন। ঘুমের মধ্যে কখনই কাশি থাকে না।
অস্বস্তিকর কফ : অনেক সময় পার্শ্ববর্তী কোনো ব্যক্তি ধূমপান করলে তামাকের ধোঁয়ার কারণে কাশি হতে পারে। এছাড়া বায়ুদূষণ, গাড়ির ধোঁয়া, আগুন প্রভৃতি কারণেও কাশি হতে পারে। অ্যাজমা এবং অ্যালার্জিতে আক্রান্ত শিশুদের এসব অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে দূরে রাখতে হবে।
চিকিৎসা : ভাইরাসজনিত কাশির ক্ষেত্রে সচরাচর কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে এমনিতেই এ কাশি সেরে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী কাশির ক্ষেত্রে প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে কাশির অন্তর্নিহিত কারণ। অ্যাজমা রাইনাইটিস, সাইনুসাইটিস, অন্ত্রের সমস্যা- এগুলো যে কোনোটি কাশির কারণ হতে পারে। গুয়াইসাইটিস, অন্ত্রের সমস্যা- এগুলোর যে কোনোটি কাশির কারণ হতে পারে। গুয়াইফেনেসিন জাতীয় কফ সিরাপ প্রয়োগে তেমন ফল পাওয়া যায় না। ডেক্সট্রোমেথরফেন জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে, খুব ভালো ফল পাওয়া যায় না। যেসব সিরাপের মধ্যে কোডেইন থাকে সেগুলো বেশ কার্যকর। এ জাতীয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি। বেশি দিন ধরে এ ওষুধ খাওয়ানো যায় না।
সার কথা হচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী কাশির মূল কারণ খুঁজে বের করে তার চিকিৎসা করতে হবে। যদি কাশির ধরন পরিবর্তিত হতে থাকে, যদি উপসর্গকারী ওষুধে কোনো ফল না হয়, যদি কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে থাকে অথবা যদি কাশির কারণে রাতে নিদ্রায় ও দিনে কর্মের ব্যাঘাত ঘটতে থাকে, তাহলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
কখন অ্যাজমা বা অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে
* ৩-৪ সপ্তাহ বা তার অধিক সময়ব্যাপী কাশি থাকলে।
* কাশির সঙ্গে যদি হাঁপানির টান থাকে।
* দীর্ঘস্থায়ী কাশির সঙ্গে যদি নাক ও সাইনাসের রোগ থাকে।
* দীর্ঘস্থায়ী কাশির সঙ্গে ধূমপান বা অন্য উত্তেজক পদার্থের সংযোগ যদি থাকে।
লেখক : অ্যাজমা ও অ্যালার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ, দি অ্যালার্জি ও অ্যাজমা সেন্টার, পশ্চিম পান্থপথ, ঢাকা মোবাইল : ০১৭২১৮৬৮৬০৬
