Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

কান পাকা ও কানের পর্দা ফাটায় করণীয়

Icon

অধ্যাপক ডা. জাহীর আল-আমীন

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কানের পর্দা ফাটা ও কান পাকা রোগের কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। অনেক কারণে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে এবং কান পাকা রোগও অনেক রকমের হতে পারে। আমরা যে কান পাকা বা কানের পর্দা ফাটার সঙ্গে পরিচিত সেটা সাধারণ সমস্যা; মারাত্মক বা জটিল কোনো অসুখ নয়। অনেক দিন এ সমস্যা থাকলে মারাত্মক জটিলতা তৈরি হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিল কিছু রোগের কারণেও কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে বা কান দিয়ে পুঁজ বা পানি পড়তে পারে।

কানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। বহিঃকর্ণ যেটা আমরা সাধারণত দেখতে পাই, মধ্যকর্ণ যেটা কানের পর্দার ওপাশে থাকে এবং অন্তঃকর্ণ যেটা থেকে কানের স্নায়ু তৈরি হয়। কানের পর্দা কানের ফুটার শেষ প্রান্তে অবস্থিত। এ পর্দার কাজ হল আমরা যে শব্দ শুনি সেই শব্দটাকে মধ্য কান দিয়ে কানের স্নায়ুতে নিয়ে যাওয়া।

কানের কাজ প্রধানত দুটি। একটি হল শব্দ শোনা যার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কানের যে দ্বিতীয় কাজটি আছে সেটা আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জানি না- সেটা হল শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা। মস্তিষ্কের বাইরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করার যে অঙ্গ আছে তার মধ্যে অন্তঃকর্ণ প্রধান ও অন্যতম। কান পাকা রোগ সাধারণত ছোটবেলাতে শুরু হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের কানের ইনফেকশন বা সর্দি-কাশি যাকে আমরা সাধারণ ভাষায় কমন কোল্ড বলে থাকি তা থেকে হয়ে থাকে। এমন কোনো বাচ্চা নেই যার জীবনে কোনো না কোনো সময় একবারও কানের ইনফেকশন হয়নি। বেশিরভাগ সময় সুষ্ঠু চিকিৎসার মাধ্যমে এ ইনফেকশনের সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। যদি এ ইনফেকশনের সুষ্ঠু চিকিৎসা না হয় বা পর্যাপ্ত চিকিৎসা না হয় তাহলে ইনফেকশন থেকে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে। যেসব বাচ্চা এডেনয়েড গ্রন্থির প্রদাহে অনেকদিন ধরে ভোগে বা যেসব বাচ্চার এডেনয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে যায় তাদের কানের সমস্যা আরও বেশি হয়ে থাকে। ঘনঘন কানের ইনফেকশন থেকে কানের পর্দা ফেটে যায়। অনেক সময় টনসিল, নাক বা সাইনাসের ইনফেকশন ঘনঘন হতে থাকলে বা সবসময় নাক বন্ধ থাকলেও কানের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। এডেনয়েড, টনসিল বা নাকের সমস্যা অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে এটা ইউস্টেশিয়ান টিউবের ওপর প্রভাব ফেলে এবং দেখা যায় টনসিল। এডেনয়েড বা নাকের সমস্যার চিকিৎসা হওয়ার পরও ইউস্টেশিয়ান টিউবের ফাংশন কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণ ফিরে আসে না। এর ফলে কান পাকা বা কানের পর্দা ফাটার রোগীর চিকিৎসা জটিল আকার ধারণ করে বা এটা সহজে সারতে চায় না।

বড়দের ক্ষেত্রে কান পাকা রোগটা সাধারণত ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়ে থাকে। তাদের হয় ছোটবেলা থেকেই কানের পর্দা ফাটা থাকে অথবা ইউস্টেশিয়ান টিউবের কার্যক্ষমতা ব্যাহত হওয়ার জন্য কানের পর্দা আগে থেকেই দুর্বল থাকে। অনেক সময় দেখি কানের ভেতর পানি গেলে কান পাকা শুরু হয়। আপাতত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়; কিন্তু কানের ভেতরে পানি গেলে কান পাকা রোগ শুরু হওয়ার কথা নয়। যদি তাই হতো তাহলে যারা নিয়মিত সাঁতার কাটেন তাদের কান সব সময় পাকা থাকত। প্রকৃত তথ্য হল, এ রোগীদের কানের পর্দা আগে থেকেই ফাটা থাকে যার ফলে কানের ভেতর পানি গেলে তাদের কান পেকে যায়। আবার অনেক সময় দেখা যায় অল্প আঘাতেই কানের পর্দা ফেটে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কানের পর্দা সুস্থ থাকলে অল্প আঘাতে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার কথা নয়- যদি এ রকম ঘটে তাহলে বুঝতে হবে, কানের পর্দা আগে থেকেই অসুস্থ বা দুর্বল ছিল। অবশ্য কানের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হলে সুস্থ পর্দাও ফেটে যেতে পারে। যেমনটি হতে পারে কানে ভালোমতো থাপ্পড় লাগলে। অনেক সময় দেখা যায়, অল্প সর্দি-কাশিতে কানের পর্দা ফেটে গিয়ে পুঁজ-পানি বের হচ্ছে। কানের পর্দা সুস্থ থাকলে এ রকম হওয়ার কথা নয়। বয়স্ক রোগীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছোটবেলা থেকে কানের পর্দা দুর্বল থাকে অথবা ক্রমাগত নাক বা সাইনাসের প্রদাহের কারণে বা ক্ষেত্রবিশেষে টনসিলের ক্রমাগত প্রদাহের কারণে কানের পর্দা দুর্বল হয়ে যায়।

উপসর্গ

রোগী কানে কম শুনতে পারেন- এটা সামান্য থেকে মারাত্মক পর্যন্ত হতে পারে। কান পাকার জন্য কান দিয়ে পুঁজ পানি বের হয়। অনেক সময় মাথা ঘোরায়। মাথার ভেতরে ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়। অনেক সময় কানে ব্যথা হতে পারে। এ কান দিয়ে পুঁজ পানি পড়াটা প্রাথমিক পর্যায়ে মাঝে মাঝে হয়; কিন্তু ক্রমাগত কান পাকতে থাকলে অনেক সময় দেখা যায়, কান কোনো সময় শুকাতেই চায় না। অনেক সময় আবার সর্দি-কাশি লাগলেই কান দিয়ে পানি বের হতে থাকে।

প্রকারভেদ

সাধারণত কানের পর্দা ফাটা দুই রকমের হয়ে থাকে- একটাতে পর্দার সামনের অংশ ফুটা থাকে অন্যটিতে কানের পর্দার পেছনের অংশটাতে ফুটা থাকে। পেছনের ফুটা সাধারণত মারাত্মক- চিকিৎসা অতি শিগগিরই শুরু করা দরকার। অনেক সময় অনেক দিন ধরে কানের পর্দা ফুটা থাকার ফলে এবং ঘনঘন কানের ইনফেকশন থাকার ফলে পর্দাটা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

সাধারণ করণীয়

পর্দা ফাটা থাকলে অবশ্যই কান শুকনা রাখতে হবে। কানের ভেতর যেন পানি না যায়। গোসল করার সময় তুলাতে তেল দিয়ে ভিজিয়ে তারপর তুলাকে চিপে কানে দিয়ে গোসল করতে হবে। কোনো সময়ই পানির তলে সাঁতার কাটা যাবে না বা পানিতে ঝাঁপ দেয়া যাবে না। কানে ইনফেকশন থাকলে কানটা ঠিকমতো পরিষ্কার করা দরকার এবং তারপর কানে অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ দিতে হয়। কান পরিষ্কার করা জরুরি এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে এটা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কদাচিৎ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হবে বা ইনজেকশন দেয়া লাগতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ কান শুকনা অবস্থায় কানে দেয়া নিষেধ- এটা কানে মারাত্মক ক্ষতি করে ফেলতে পারে, এমনকি কানে শোনা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কাজেই শুকনা কানে ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ ব্যবহার করার প্রবণতা অবশ্যই দূর করতে হবে। কানে শোনা এবং কানের অন্যান্য ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য অডিওগ্রাম করানো দরকার। এতে বোঝা যায় কান কতখানি নষ্ট হয়েছে। অনেক সময় সমস্যা আমরা বুঝতে পারি না; কিন্তু ভেতরে ভেতরে কানের ক্ষতি হতে থাকে এবং শ্রবণশক্তি ক্রমাগত কমতে থাকে। কাজেই প্রতি ৩ থেকে ৬ মাস অন্তর কানের হেয়ারিং টেস্ট করে শ্রবণশক্তির পরিমাণ রেকর্ড করা উচিত।

জটিলতা

কানের পর্দা ফাটা বা কান পাকা রোগ থেকে আমাদের কানের ভেতরের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হয়ে যায়, ফলে আমরা কানে কম শুনি। এটা বাড়তে বাড়তে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আগে যেমনটা বলা হয়েছে, কানের আরেকটি কাজ হল শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা। কান পাকা থেকে মাথা ঘোরানোর মতো সমস্যা হয়। কানের ইনফেকশন অনেক সময় কান থেকে ম্যাসটয়েড নামক হাড়ে চলে যায় এবং এর ফলে জ্বর এবং কানে প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ইনফেকশন কান থেকে মস্তিষ্ক বা মস্তিষ্কের আবরণীতে চলে যেতে পারে যা থেকে মেনিনজাইটিস, ব্রেন অ্যাবসেস এবং মস্তিষ্কে প্রদাহের মতো জটিল সমস্যা তৈরি হতে পারে।

এ ধরনের জটিলতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়

মস্তিষ্কের বাইরে যেমন-

* মুখ বেঁকে যাওয়া

* সম্পূর্ণ বধির হয়ে যাওয়া

* সার্বক্ষণিক মাথা ঘোরানো

* ম্যাসটয়েড হাড়ের চামড়া নিচে এবং হাড়ের পর্দার নিচে অ্যাবসেস।

* মস্তিষ্কের ভেতরে মস্তিষ্কের ঝিল্লির ইনফেকশন (মেনিনজাইটিস)

* মস্তিষ্কের ভেতরে ইনফেকশন (এনকোফালাইটিস)

* মগজের ঝিল্লি বাইরে ও ভেতরে অ্যাবসেস

কানের পর্দা না থাকার সমস্যা

* কানে কম শোনা।

* মাথা ঘুরানো- কানের কাজ দুটি। শ্রবণ ও শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা। কানের ইনফেকশন ঘনঘন হলে মাথা ঘোরানো সমস্যা হয়।

* কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ হওয়া।

* কান পাকা-কানের পর্দা না থাকলে কানের ভেতরের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি বাইরের সঙ্গে উন্মুক্ত হয়ে যায়। এর ফলে বাইরের রোগজীবাণু কানের ভেতরে সরাসরি গিয়ে কানের ইনফেকশন করে। অনেকের ধারণা কানে তুলা দিয়ে গোসল করলে কানের ইনফেকশন থেকে বাঁচা যায়। এ কথা ঠিক নয়, কানের পর্দা না থাকলে কানে তুলা দিয়ে গোসল করলে কানের ইনফেকশন কমে যায়- এ কথা সত্য; কিন্তু ইনফেকশন একেবারে রোধ করা সম্ভব নয়। পর্দা না থাকার জন্য ধুলাবালি ও বাইরের রোগজীবাণু কানের ভেতরে সরাসরি যাবে এবং কানের ইনফেকশন হবে, যতদিন কানের পর্দা জোড়া লাগানো না হয়।

লেখক : নাক কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন, সিনিয়র কনসালটেন্ট, ইমপালস হসপিটাল, ঢাকা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম