Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

ইনফেকশন ও মৃগী রোগ পর্ব (৬)

শিশুর জ্বর ও খিঁচুনিতে বাড়িতে করণীয়

Icon

অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পরিবারের কোনো সন্তানের জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হলে তা পিতা-মাতার জন্য উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রস্রাবে ও মস্তিষ্কে সংক্রমণের কারণে শিশুর খিঁচুনি হতে পারে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত কোনো কোনো শিশুর জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি অর্থাৎ জ্বরজনিত খিঁচুনি (Febrile Conuvlsion) হয়। জ্বর ছাড়া খিঁচুনি আরও উদ্বেগের বিষয়। মস্তিষ্কের জন্মগত ত্রুটি ও সমস্যা, মস্তিষ্কে আঘাত ও মৃগী রোগ (Epilepsy), শরীরে গ্লুকোজ, ক্যালসিয়াম বা সোডিয়ামের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণেও শিশুর খিঁচুনি হতে পারে। জ্বর ও খিঁচুনির কারণ ও চিকিৎসা নিয়ে লিখেছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন

জ্বরজনিত খিঁচুনি

যখন বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা হুট করে বেড়ে যায় তখন জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হয়। অনেক সময় জ্বর ওঠার শুরুতেই খিঁচুনি হয় অর্থাৎ খিঁচুনি না ওঠা পর্যন্ত বোঝা যায় না যে, জ্বর এসেছে। লক্ষণগুলো হলো- চোখ উল্টানো, শ্বাস-প্রশ্বাস কম ও খুব ধীরে ধীরে, মুখ দিয়ে লালা বের হয়, নীল হয়ে যায়, গায়ে অনেক জ্বর আসে, অজ্ঞান হয়ে যায়, ৫ মিনিট পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।

জ্বরজনিত খিঁচুনির বৈশিষ্ট্য

* ৬ মাস থেকে ৬ বছর পর্যন্ত শিশুদের এ সমস্যা হয়।

* সাধারণত ৩ থেকে ৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট পর্যন্ত হতে পারে। ১৫ মিনিটের বেশি খিঁচুনি হওয়াটা অস্বাভাবিক।

* জ্বরজনিত খিঁচুনিতে দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়িত থাকে। যদি একটি অঙ্গ বা একপাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়িত থাকে তবে সে ক্ষেত্রে তা অস্বাভাবিক ও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

* জ্বরের প্রথম দিনই সাধারণত খিঁচুনি হয়। জ্বর যখন বাড়তে থাকে সাধারণত তখনই এ ধরনের খিঁচুনি হয়।

* শতকরা তিনজন শিশুর ক্ষেত্রে জ্বরজনিত খিঁচুনি হয়।

* আগের বাচ্চার ক্ষেত্রে খিঁচুনি হলে পরের বাচ্চার ক্ষেত্রে খিঁচুনির আশঙ্কা বেশি থাকে। বাবা বা মায়ের খিঁচুনির ইতিহাস থাকলে বাচ্চার ক্ষেত্রে তা বেশি হয়।

* গলার প্রদাহ বা শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহে সবচেয়ে বেশি খিঁচুনি হয়। তবে পেটের অসুখ, রক্ত আমাশয়ে জ্বর হলে খিঁচুনি হতে পারে।

* বাচ্চার স্বাভাবিক গড়ন ও গঠনে কোনো ক্ষতি হয় না। একটা বয়সের পর জ্বর হলেও আর খিঁচুনি হবে না।

* একবারের জ্বরে একবারই খিঁচুনি হয়। তবে ২ বা ৩ বারও হতে পারে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে।

* খিঁচুনির পরে খিঁচুনির প্রভাব শরীরে থাকে না।

তাৎক্ষণিক করণীয়

* আকস্মিক পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা বাঞ্ছনীয় এবং শিশুকেও শান্ত রাখা জরুরি।

* বাচ্চাকে এমন নিরাপদ স্থানে রাখুন, যাতে সে পড়ে না যায় কিংবা শরীরে অন্য কোনো বস্তুর আঘাত না লাগে।

* বাচ্চাকে নরম কিছুর ওপর এক পাশে কাত করে কিংবা উপুড় করে শোয়াতে হবে। এতে মুখ থেকে নিঃসৃত লালা শ্বাসনালিতে যাওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। একই সঙ্গে লালা পরিষ্কার করতে হবে যেন তা শ্বাসনালির পথ বন্ধ না করে। এ ক্ষেত্রে বাল্ব সাকার ব্যবহার করা যায়।

* মলদ্বারে একটি প্যারাসিটামল সাপোজিটরি (বয়স অনুযায়ী ১২৫ মি.গ্রা. বা ২৫০ মি.গ্রা.) দিয়ে জ্বর কমাতে হবে।

* একটি ডায়াজিপাম সাপোজিটরি (০.৫ মি.গ্রা.) মলদ্বারে দিতে হবে।

* খিঁচুনির সময় বাচ্চার শরীরে জ্বর থাকলে তার কাপড়চোপড় খুলে ফেলুন এবং তাকে ঠান্ডা রাখুন। কুসুম গরম পানি দিয়ে গা-হাত-পা মাথা মুছিয়ে দিতে হবে।

* বাচ্চার নড়াচড়ার ধরন এবং খিঁচুনি কতক্ষণ স্থায়ী থাকে সেটা খেয়াল করুন। যাতে পরে চিকিৎসকের কাছে গেলে ভালোভাবে বর্ণনা দিতে পারেন।

* খিঁচুনির পর বাচ্চাকে বিশ্রামে রাখতে হবে।

খিঁচুনির সময় যা করা যাবে না

* বাচ্চার দুই দাঁতের পাটির মাঝখানে জোর করে আঙুল, চামচ বা অন্য কোনো বস্তু ঢোকানো উচিত নয়।

* বাচ্চাকে ধরার কিংবা তার কাঁপুনি বন্ধ করার চেষ্টা করা ঠিক নয়।

* খিঁচুনির সময় বাচ্চাকে কোনো কিছু পান করানো কিংবা মুখে কোনো কিছু দেওয়া ঠিক নয়।

* খিঁচুনি থামানোর জন্য বাচ্চাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করা একেবারেই অনুচিত।

* খিঁচুনি থামানোর জন্য বা শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা কমানোর জন্য বাচ্চাকে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করানো যাবে না।

চিকিৎসা

* শিশুদের জ্বর হলে শুরুতে বয়স ও ওজন অনুসারে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়াতে হবে।

* বয়স এবং ওজন অনুযায়ী ডায়াজিপাম গ্রুপের ওষুধ পরিমাণমতো খাওয়াতে হবে।

* ওষুধ অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত।

* যদি তিন দিনের মধ্যে জ্বর ভালো না হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

* প্রথম কনভালশনের শুরুতেই শিশুকে হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।

পরবর্তীতে করণীয়

একবার জ্বরজনিত খিঁচুনি হলে পরে যাতে আর না হয় সে ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যা করতে হবে-

* বাচ্চার ৬ বছর বয়স পর্যন্ত জ্বর হলে খিঁচুনি হতে পারে। জ্বর হলে বাচ্চাকে প্রয়োজনমতো (১৫ মি.গ্রা. প্রতি কেজি ওজনের জন্য) প্যারাসিটামল সকাল-দুপুর-বিকাল-রাত্রি ৬ ঘণ্টা পর পর খাওয়াতে হবে।

* ট্যাবলেট ডায়াজিপাম গুঁড়া করে গুলে তিন বার খেতে দিন (০.৩ মি.গ্রা. প্রতি কেজি ওজনের জন্য) তারপর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

সতর্কতা

বাচ্চার বয়স যদি ৬ মাসের নিচে হয় কিংবা ৬ বছরের বেশি হয়, যদি ১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে খিঁচুনি হয় তাহলে সতর্ক হতে হবে। যদি খিঁচুনির পর শরীরে অবশ ভাব থাকে তাহলেও সতর্ক থাকতে হবে। যদি শরীরের এক পাশেই খিঁচুনি হয় তাহলে সচেতন হোন। অবশ্যই মস্তিষ্কে প্রদাহকে জ্বরজনিত খিঁচুনি বলে ভুল করা যাবে না। মস্তিষ্কের প্রদাহকে মেনিনজাইটিস বা ইনকেফালাইটিস বলে। এটি এক ধরনের মারাত্মক প্রদাহ। সেখানে ঘাড় শক্ত হবে, ছোট শিশুর মাথার তালুর নরম জায়গাটা উঁচু হয়ে যাবে। চোখ মেলে আলোর দিকে তাকাতে পারবে না। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে (১৪ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হতে পারে)।

আশঙ্কা

জ্বরজনিত খিঁচুনির ক্ষেত্রে শতকরা মাত্র ২ থেকে ৪ জনের মৃগী রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্বাভাবিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামগ্রিক মৃগী রোগ শতকরা প্রায় ২ জনের হয়।

কখন হাসপাতালে নিতে হবে

* বাচ্চার শরীর নীল হয়ে গেলে কিংবা তার খিঁচুনি পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হলে।

* খিঁচুনি থেমে যাওয়ার পরও শিশুর জ্ঞান না ফিরলে, শিশুকে অনেক বেশি অসুস্থ আর দুর্বল দেখালে।

* দীর্ঘক্ষণ ধরে খিঁচুনি অর্থাৎ ১৫ মিনিট বা তার বেশি সময় হলে।

* এক ঘণ্টার মধ্যে তিন বার বা তার বেশি খিঁচুনি হলে, অথবা শরীরের একদিকে বা এক অঙ্গে খিঁচুনি হলে।

জ্বরজনিত খিঁচুনি ও মৃগী রোগের পার্থক্য

জ্বরজনিত খিঁচুনি জ্বরের প্রারম্ভে বা উচ্চমাত্রার জ্বরের সময় হয়। মৃগী একটি স্নায়ুবিক রোগ যাতে খিঁচুনি হয়। জ্বরজনিত খিঁচুনি সাধারণত ৬ মাস থেকে ৬ বছরের বাচ্চাদেরই হয়ে থাকে। তবে মৃগী রোগ যে কোনো বয়সে হতে পারে। এ রোগের প্রকৃত কারণ জানা না গেলেও মস্তিষ্কে আঘাত, স্ট্রোক, মস্তিষ্কে টিউমার বা জন্মগত ত্রুটি সম্ভাব্য কারণ। বংশগত বা জিনগত মিউটেশনও কিছুকিছু ক্ষেত্রে দায়ী। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোর অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক ক্রিয়ার ফলে খিঁচুনি হয়। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ থেকে বিদ্যুৎ তরঙ্গ তখন হঠাৎ হঠাৎ চমকাতে থাকে তখন শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-ঝাঁকুনি ওঠা, শরীর শক্ত হয়ে যাওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, আচরণে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যাওয়া। মস্তিষ্কের কিছু কেমিক্যালের হঠাৎ তারতম্য হলে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের হঠাৎ অতিরিক্ত ক্রিয়াকলাপ শুরু হলে মৃগী রোগে খিঁচুনি হয়ে থাকে। মৃগী স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতাজনিত একটি রোগ। মস্তিষ্কের শরীরের কার্য পরিচালনাকারী জায়গায় স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপক ও নিবৃত্তিকারক অংশদ্বয়ের কার্যপ্রণালির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে মৃগী রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম