নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কী করবেন
ডা. জুবায়ের আহমদ
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালে যে কোনো ধরনের বড় এবং জটিল রোগও আগে থেকে ধরা পড়ে। সাধারণত অনেকে অনেক রোগের উপসর্গই এড়িয়ে যান। কঠিন রোগের ক্ষেত্রেও উপসর্গগুলোকে সাধারণ উপসর্গ ভাবেন। সেভাবে পরিচিত কিছু ওষুধ খেয়ে উপসর্গগুলো চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এতে রোগ কমে না। বরং আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। আর শেষে যখন রোগটি ধরা পড়ে, তখন জটিল চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তাই স্বাস্থ্য পরীক্ষা সব সময় জরুরি। এতে আগে থেকে রোগ হচ্ছে কিনা সেটা জানা যায়। বিস্তারিত লিখেছেন শিশু ও মহিলা বাত ও লুপাস এবং মেডিসিন, অ্যালার্জি ও রিউম্যাটোলজি বিশেষজ্ঞ, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের কনসালট্যান্ট
ডা. জুবায়ের আহমদ
* কেসস্টাডি
সুইটি জামান, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কাজের চাপে নিজের শারীরিক ও মানসিক যত্ন নিতে ভুলে যান। হালকা মাথাব্যথা বা বমিভাব হলেও কখনো এসব অসুস্থতাকে পাত্তা দেন না, নিজেকে সব সময় কর্মব্যস্ত রাখেন। কিছুদিন ধরে তিনি ঘাড়ের পেছনে ও মাথায় অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব করছিলেন। বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে ভেবে ব্যথা শুরু হওয়ার পর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যান। বাসায় যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বাড়তে থাকে ব্যথা ও অস্বস্তি। রান্নাঘর থেকে শোবার ঘরে পৌঁছার আগেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে দেখতে পান হাসপাতালের বিছানায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছে, তার স্ট্রোক হয়েছে।
এ রকম দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে আমাদের চারপাশে। অসুখের উপসর্গকে আমলে না দেওয়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে অনেক বেশি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ও নিজের শরীরের খোঁজখবর রাখার মতো জরুরি কাজটা আমরা ভুলে যাই। পরবর্তীতে জেঁকে বসে বড় ধরনের রোগবালাই। নিজেকে সুস্থ রাখার তাগিদে নিুলিখিত পরীক্ষাগুলো নিয়মিত করা প্রয়োজন।
* উচ্চরক্তচাপ
সাধারণত চল্লিশের পর উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে উচ্চরক্তচাপ হতে পারে যে কোনো বয়সেই। উচ্চরক্তচাপের কারণে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি জটিলতাসহ নানা সমস্যা হতে পারে।
* রক্তে শর্করা
রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, স্ট্রোক, অন্ধত্ব, হৃদরোগসহ নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ডায়াবেটিস শনাক্ত করতে নিয়মিত রক্তে শর্করার পরিমাণ পরীক্ষা করা দরকার।
* চক্ষু পরীক্ষা
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। চোখে ছানি পড়াসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। গ্লুকোমা হলে চোখের অপটিক নার্ভ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীকালে দৃষ্টিহীনতা দেখা দেয়। তাই চল্লিশের পর বছরে একবার চক্ষু পরীক্ষা করাতে হবে।
* লিপিড প্রোফাইল
উচ্চরক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে এবং বয়স ৩৫-এর বেশি হলে বছরে অন্তত একবার রক্তের লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করাতে হবে।
* ক্যানসার স্ক্রিনিং
ক্যানসারজনিত মৃত্যুর অন্যতম কারণ কোলোরেক্টাল ক্যানসার। এ রোগের উপসর্গ প্রাথমিক অবস্থাতে বোঝা যায় না। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে লক্ষণ প্রকাশ পায়। তখন আসলে আর কিছুই করার থাকে না। তাই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে পরীক্ষাটি করাতে হবে। চল্লিশের পর পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসার ও নারীদের জরায়ুমুখ ক্যানসার পরীক্ষা করা জরুরি।
* হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা
বয়স চল্লিশ পেরোলেই অস্টিওপোরেসিস, আর্থ্রাইটিসসহ হাড়ের নানা রোগ দেখা দিতে শুরু করে। হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ঘনত্ব পরীক্ষার মাধ্যমে হাড়ের রোগ সম্পর্কে জানা যায়।
* দাঁতের পরীক্ষা
দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্ম বোঝে না-প্রচলিত এ প্রবাদটি মিথ্যা প্রমাণ করতে আমাদের সবার উচিত দাঁতের যত্ন নেওয়া। দাঁতের পরীক্ষায় ফাঁকি না দিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা করা ও চিকিৎসার মাধ্যমে দাঁতের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।
* স্থূলতা বা ওবেসিটি
স্থূলতার কারণে নানা ধরনের সমস্যা ও রোগবালাই দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে অনেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। নিয়মিত রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষার মাধ্যমে এ ধরনের মানুষের হঠাৎ আসা স্বাস্থ্যগত বিপদ এড়ানো যায়।
* চোখ পরীক্ষা
যাদের মাইগ্রেনের সমস্যা আছে বা নিয়মিত চশমা ব্যবহার করতে হয়, তাদের ছয় মাস অন্তর হলেও চক্ষু পরীক্ষা করা জরুরি।
* নারীস্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরীক্ষা
বয়স ত্রিশ পার হলে নারীরা মারাত্মক সব রোগের ঝুঁকিতে থাকেন। এ সময় প্রত্যেক নারীর উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো।
* ম্যামোগ্রাম
স্তন ক্যানসার শনাক্ত করতে ম্যামোগ্রাম করা হয়। বিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সি প্রত্যেক নারীর দুই থেকে তিন বছর পরপর হলেও এ পরীক্ষাটি করা উচিত।
* থাইরয়েড পরীক্ষা
নারীদের মধ্যে থাইরয়েডের সমস্যা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। নিয়মিত থাইরয়েড পরীক্ষা করলে জটিলতা বাড়ার আগেই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া, ক্লান্তি ও অবসাদ, নখ ভেঙে যাওয়া, ত্বকের শুষ্কতার মতো সমস্যা দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে থাইরয়েড পরীক্ষা করাতে হবে।
* প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষা
সার্ভিক্যাল বা জরায়ুমুখ ক্যানসার শনাক্ত করতে প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষা করা হয়। নারীদের অকালমৃত্যুর অন্যতম কারণ সার্ভিক্যাল ক্যানসার। একুশ বছর বয়সের পর প্রত্যেক নারীর এ পরীক্ষাটি করা উচিত।
* নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুফল
▶ শরীরে যদি কোনো জটিল রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি শুরুতেই ধরা পড়ে। ফলে বিস্তার লাভের আগেই উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় করা যায়।
▶ অনেকের বংশগত রোগ থাকে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি পর্যবেক্ষণ করা যায়।
▶ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে মানসিকভাবে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
▶ আগেই রোগ ধরা পড়লে সতর্কতার মাধ্যমে জটিলতা এড়ানো যায়।
▶ রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে চিকিৎসার খরচ অনেকাংশে কমানো যায়।
ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ওবেসিটির মতো সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া, রাত জাগা, মানসিক চাপসহ জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে অল্প বয়সিদেরও নানা জটিল রোগ ঘিরে ধরছে। সুস্থ থাকতে শুধু বয়স্কদের নয়, সাতাশ থেকে সত্তর-যে কোনো বয়সিদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি।
