Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

শারীরিক কার্যকলাপ কেন প্রয়োজন

Icon

ড. আসাদুজ্জামান খান ও ড. কাজী রুমানা আহমেদ

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শারীরিক কার্যকলাপ কেন প্রয়োজন

স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা এবং সামগ্রিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য শারীরিক কার্যকলাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক কার্যকলাপ বলতে, কঙ্কালের পেশি দ্বারা সৃষ্ট যে কোনো শারীরিক নড়াচড়াকে বোঝায় যার জন্য শক্তি ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। অবসর সময়ে ভ্রমণ (যেমন, হাঁটা বা সাইকেল চালান), পেশাগত কাজ এবং গৃহস্থালির কাজকর্ম এর অন্তর্ভুক্ত। শারীরিক কার্যকলাপকে হৃদস্পন্দনের হার ও শক্তি ব্যয়ের মাত্রার ভিত্তিতে নিম্ন, মাঝারি এবং উচ্চ তীব্রতার শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। নিম্ন-তীব্রতার কার্যকলাপ (যেমন সাধারণ হাঁটা বা গৃহস্থালির কাজ, রান্না করা, বাসন ধোয়া) কিছু উপকার প্রদান করতে পারে, তবে আরও উল্লেখযোগ্য উপকার পেতে মাঝারি ও উচ্চ-তীব্রতার কার্যকলাপ প্রয়োজন। মাঝারি-তীব্রতার কার্যকলাপ (যেমন দ্রুত হাঁটা বা সাইকেল চালান) হৃদস্পন্দনের হার ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়, আর উচ্চ-তীব্রতার কার্যকলাপ (যেমন জগিং বা ফুটবল খেলা) হৃদস্পন্দনের হার ৭০ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে।

উচ্চ তীব্রতার শারীরিক কার্যকলাপের উদাহরণ হিসাবে রয়েছে হাইকিং, দ্রুত জগিং, দ্রুত সাইক্লিং, বাস্কেটবল খেলা, ফুটবল এবং একক টেনিস খেলা।

ব্যায়াম এবং খেলাধুলা হচ্ছে শারীরিক কার্যকলাপের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ব্যায়াম হলো পরিকল্পিত, কাঠামোগত এবং পুনরাবৃত্তিমূলক শারীরিক কার্যকলাপ যা শারীরিক অবস্থা এবং স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য আমরা করে থাকি; যেমন, লম্বা সময় ধরে জগিং করা, জিমে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপ করা, বেশ কয়েকটি ধাপে পৌঁছানর জন্য দৈনিক হাঁটা ইত্যাদি।

WHO-এর নির্দেশিকায় প্রাপ্তবয়স্কদের সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতা বা ৭৫ মিনিট উচ্চ তীব্রতার শারীরিক কার্যকলাপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে । শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের জন্য, প্রতিদিন এক ঘণ্টা মাঝারি থেকে উচ্চ তীব্রতার শারীরিক কার্যকলাপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

* শারীরিক কার্যকলাপের গুরুত্ব কী

শারীরিক কার্যকলাপ, মানসিক এবং সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্য গভীর উপকার বয়ে আনে। নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস এবং নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসারের মতো অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ এবং পরিচালনা করতে সাহায্য করে। এটি হতাশা এবং উদ্বেগের লক্ষণগুলো হ্রাস করে, জ্ঞানীয় কার্যকারিতা উন্নত করে এবং ভালো ঘুমের প্রচার করে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে। শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের সুস্থ বৃদ্ধি এবং বিকাশ নিশ্চিত করতে শারীরিক কার্যকলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুবিধার বাইরেও, শারীরিক কার্যকলাপ বৃহত্তর সামাজিক লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, অধিক শারীরিক কার্যকলাপ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করতে পারে, যার ফলে পরিষ্কার বায়ু এবং নিরাপদ রাস্তা তৈরি হয়। WHO অনুমান করে, বিশ্বব্যাপী প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন (২৭ শতাংশ) শারীরিক কার্যকলাপের প্রস্তাবিত স্তর পূরণ করে না এবং ৮০ শতাংশেরও বেশি কিশোর-কিশোরী অপর্যাপ্তভাবে সক্রিয়। শারীরিক নিষ্ক্রিতা একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহারের চতুর্থ প্রধান ঝুঁকির কারণ হিসাবে স্বীকৃত। অপর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপ মৃত্যুর ঝুঁকি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করে, যা একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করে। ১৯৪টি দেশে সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার বিশ্বব্যাপী বার্ষিক খরচ প্রায় ৪৭.৬ বিলিয়ন ডলার।

* বাংলাদেশে শারীরিক কার্যকলাপের বাধা

বাংলাদেশে শারীরিক কার্যকলাপে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা নগরায়ন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে।। দ্রুত নগর উন্নয়নের ফলে পার্ক, খেলার মাঠ এবং খোলা জায়গাগুলো মারত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ করে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো বড় শহর যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। পথচারীদের জন্য উপযুক্ত ফুটপাতের অভাব, যানজটপূর্ণ রাস্তা এবং ভারী যানবাহনের চলাচল জনগণের হাঁটা, জগিং বা সাইকেল চালানকে নিরুৎসাহিত করে। ক্রমবর্ধমান বিনোদনের জন্য স্ক্রিন টাইম, মোটরচালিত পরিবহণের ওপর নির্ভরতা এবং ডেস্ক-বাউন্ড চাকরির কারণে বসে থাকা জীবনযাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলেছে, যা প্রাপ্তবয়স্ক এবং তরুণ উভয়কেই খারাপভাবে প্রভাবিত করছে।

স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য শারীরিক কার্যকলাপের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব একটি বড় বাধা। স্কুলগুলোতে প্রায়শই শারীরিক শিক্ষাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেখানে শিক্ষাগত চাপ খেলাধুলার বা শারীরিক কার্যকলাপের পরিবর্তে অন্য বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পায়। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে, কারণ জিম, খেলাধুলার সুবিধা বা বিনোদনমূলক সরঞ্জামের অ্যাক্সেস অনেকের, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার মানুষের, ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।

* বাংলাদেশে শারীরিক কার্যকলাপ উন্নয়নে করণীয়

বাংলাদেশে শারীরিক কার্যকলাপের নিম্ন স্তরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সরকারি নীতি, সম্প্রদায়ের উদ্যোগ এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার সমন্বয়ে বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা জনস্বাস্থ্য লক্ষ্য হিসাবে শারীরিক কার্যকলাপকে অগ্রাধিকার দেবে। নীতি উন্নয়নের পাশাপাশি, শহর ও গ্রামাঞ্চলে পার্ক, খেলার মাঠ, পথচারীর সহায়ক ফুটপাত এবং সাইক্লিং লেনের মতো অবকাঠামোতে বিনিয়োগ অপরিহার্য। এ ধরনের অবকাঠামো শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমভাবে স্থাপন করা উচিত, যাতে জনগণের সব স্তরের মানুষ শারীরিক কার্যকলাপের জন্য নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশে অংশগ্রহণ করতে সুযোগ পায়। এ ছাড়া জনসাধারণের স্থানগুলো এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে, যাতে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে তা ব্যবহার করতে পারেন, পাশাপাশি উপযুক্ত আলো ও নজরদারি ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।

শারীরিক কার্যকলাপের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। টেলিভিশন, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া এবং কমিউনিটি ইভেন্টস ব্যবহার করে দেশব্যাপী প্রচারণা কার্যকরভাবে বিভিন্ন শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে পারে, এবং সক্রিয় থাকার গুরুত্ব সম্পর্কে বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে।

সামাজিক সম্পৃক্ততা শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে পারে। হাঁটার দল, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ফিটনেস ক্লাস এবং নৃত্য সেশনের মতো সামাজিকভিত্তিক প্রোগ্রামের আয়োজন কেবল শারীরিক কার্যকলাপকে উৎসাহিত করে না বরং সামাজিক সংযোগ এবং সম্মিলিত প্রেরণাকেও উৎসাহিত করে। ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য এ ধরনের প্রোগ্রাম সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল এবং সর্বজনগৃহীত হওয়া উচিত, যা সব বয়সি এবং ভিন্ন সক্ষমতার মানুষ অংশ নিতে পারে।

শারীরিক কার্যকলাপ প্রচারের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা গুরুত্বপূর্ণ। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বাধা প্রায়ই মহিলাদের ব্যায়াম ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর সমাধানের মধ্যে রয়েছে শুধু মহিলাদের জন্য ফিটনেস সেন্টার বা জিম, ক্রীড়া প্রোগ্রাম এবং ব্যায়ামের জন্য নিরাপদ স্থান তৈরি করা। সক্রিয় নারী ও মেয়েদের রোল মডেল এবং সাফল্যের গল্প তুলে ধরা যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে পারে।

প্রযুক্তি শারীরিক কার্যকলাপকে উৎসাহিত করার জন্য আশাব্যঞ্জক সুযোগ প্রদান করতে পারে। মোবাইল অ্যাপস, পরিধেয় ডিভাইস এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যক্তিকেন্দ্রিক ওয়ার্কআউট পরিকল্পনা এবং প্রেরণামূলক সামগ্রী সরবরাহ করতে পারে, যা ব্যবহারকারী তাদের ফিটনেস যাত্রায় নিযুক্ত রাখতে পারে।

অন্য দেশের সফল মডেল, যেমন সাইকেল-শেয়ারিং সিস্টেম বা স্কুলভিত্তিক ফিটনেস উদ্যোগ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। পাশাপাশি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহণ এবং নগর পরিকল্পনার মতো সেক্টরে অংশীদারদের সম্পৃক্ত করা একযোগে একাধিক বাধা মোকাবিলা করার জন্য সামগ্রিক সমাধান তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।

ড. আসাদুজ্জামান খান : সহযোগী অধ্যাপক, স্কুল অফ হেলথ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সায়েন্সেস, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া এবং সভাপতি, অ্যাকটিভ হেলদি কিডস, বাংলাদেশ।

ড. কাজী রুমানা আহমেদ : অ্যাডজাঙ্কট রিসার্চার, স্কুল অফ হেলথ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সায়েন্সেস, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া সদস্য সচিব, অ্যাকটিভ হেলদি কিডস, বাংলাদেশ।

শারীরিক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম