Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

ফাইব্রোমায়ালজিয়া

শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা ও দুর্বলতা

Icon

অধ্যাপক ডা. একেএম আখতারুজ্জামান

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইব্রোমায়ালজিয়া শব্দটি শুনলে নতুন মনে হলেও এ রোগটির উপসর্গের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। যেমন-শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা হওয়া, দুর্বলতা, ঘুমহীনতা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়াসহ অন্য শারীরিক সমস্যা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফাইব্রোমায়ালজিয়া মানসিক রোগ হিসাবে বিবেচিত হতো। ১৯০৪ সালে গাওয়ার নামের একজন চিকিৎসক সর্বপ্রথম ফাইব্রোসাইটিস শব্দটি ব্যবহার করেন, যা ১৯৭৬ সালে ফাইব্রোমায়ালজিয়া নামে পরিচিতি পায়। ফাইব্রোমায়ালজিয়া একটি জটিল, দীর্ঘস্থায়ী এবং যন্ত্রণাদায়ক রোগ। এর কারণে শরীরের সব পেশি আক্রান্ত হয়। ফলে শরীরের পেশি, টেন্ডন এবং লিগামেন্টে টান সৃষ্টি করে, যা আমাদের ব্রেনের স্নায়ুকে উত্তেজিত করে এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা অনুভব করায়। ফাইব্রোমায়ালজিয়ার ব্যথাটি শরীরে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে যায় এবং এ রোগী সাধারণত যন্ত্রণার প্রতি বেশি সংবেদনশীল হয়।

* কাদের হয়

পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ৬.৪ শতাংশ লোকের হয়ে থাকে এবং নারীদের মধ্যে তার পরিমাণ ৭.৭ শতাংশ। বাংলাদেশে গড়ে শতকরা ৩.৬ জনের ফাইব্রোমায়ালজিয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে নারীদের ৬.২ শতাংশ আর পুরুষের হার ০.৯ শতাংশ।

* লক্ষণ

▶ শরীরজুড়ে ব্যথা, বিশেষ করে মাংসপেশি ও হাড়ে ব্যথা।

▶ ক্লান্তি বা দুর্বলতা।

▶ ঘুমের ব্যাঘাত বা ঘুমহীনতা।

▶ শারীরিক পরিশ্রম বা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে অনাগ্রহ।

▶ স্মরণশক্তি কমে যাওয়া।

▶ ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় ভোগা।

* উপসর্গ

▶ দীর্ঘস্থায়ী ও পুরো শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা হওয়া।

▶ শরীরে জ্বালাপোড়া বা কাঁপুনি অনুভব করা।

▶ তীব্র ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা।

▶ ঘুমে ব্যাঘাত ঘটা বা ঘুমহীনতা।

এ ছাড়া আরও কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন-

▶ মাংসপেশি এবং জয়েন্টগুলোয় টান লাগা ।

▶ শরীরে স্পর্শ করলেই টান লাগা বা ব্যথা অনুভব করা।

▶ হাতে ও পায়ে অবশ অনুভব হওয়া।

▶ মনোযোগ, চিন্তাশক্তিতে ব্যাঘাত ঘটে। এমনকি স্মৃতিশক্তিতেও প্রভাব ফেলে এবং রোগীর মধ্যে স্মরণশক্তি কমে যাওয়া ও ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।

▶ আলো, শব্দ, গন্ধ, তাপমাত্রার প্রতি অতিরিক্ত মাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে যাওয়া।

▶ হজম ক্রিয়ায় সমস্যা হয়। যেমন-পেট ফুলে থাকা বা কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া।

▶ ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় ভোগা।

* কেন হয়

প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি। গবেষকদের মতে, এটি হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে কোনো ট্রমা বা দুর্ঘটনা, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া, মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং অন্য কোনো রোগ বা অসুস্থতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বংশগতির প্রভাবও থাকতে পারে। শরীরের কোনো জিন যেমন সেরেটোনিন, ডোপামিন এবং ক্যাটাকোলামিন বা জিন মিউটেশনের কারণে হতে পারে।

* ফাইব্রোমায়ালজিয়ার ব্যথা কখন বেশি হয়

সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যায় বেশি অনুভব হয়। অনেকের ক্ষেত্রে সারা দিনও ব্যথা অনুভব হয়ে থাকতে পারে। অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরমে, অস্থিরতা, বিষণ্নতা বা অতিরিক্ত পরিশ্রম করলেও ব্যথা অনুভব হতে পারে।

* কীভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়

এটি নির্ণয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। সাধারণত এ ধরনের রোগীর ব্যথার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেস্ট স্বাভাবিক হয়ে থাকে। মূলত রোগটি রোগীর শারীরিক উপসর্গ, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা এবং কিছু ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা নির্ণয় করা হয়।

* চিকিৎসা

ফাইব্রোমায়ালজিয়া রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা, উপসর্গ এবং উপসর্গের তীব্রতার ওপর। যদিও এটি সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়, কিন্তু উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। উপসর্গের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের জন্য মূলত একজন ব্যথা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।

* যা করবেন

▶ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া। যেমন-ব্যথা হলে ব্যথানাশক ওষুধ সময়মতো খাওয়া।

▶ ইন্ট্রাভেনাস ড্রাগ চ্যালেঞ্জেস-এ রোগের একটি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি।

▶ ব্যায়াম ও ফিজিক্যাল থেরাপি।

▶ বিষণ্নতা ও অস্থিরতার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা।

▶ রিলাক্সেশন বা শিথিলায়ন পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা রাখে।

▶ প্রয়োজন অনুযায়ী ঠান্ডা বা গরম সেক।

▶ শরীরে ম্যাসাজ করা।

▶ সাইকোথেরাপি, যেমন-কগনেটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি এবং বিহেভিয়ার মেডিসিন থেরাপি খুব কার্যকর।

* রোগীর করণীয়

▶ প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ লবণ, মিনারেল, স্নেহসমৃদ্ধ খাবার রাখা।

▶ ফাস্টফুড বা কোমল পানীয় যথাসম্ভব পরিহার করা।

▶ অধিক চিনি ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার না খাওয়া।

▶ পরিমিত পরিমাণ আমিষজাতীয় খাবার খেতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে প্রাণিজ আমিষের ক্ষেত্রে মাংসের তুলনায় মাছকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

▶ ওমেগা-৩ অ্যাসিডসমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে, যা শরীরের জন্য উপকারী।

▶ ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ শাকসবজি যেমন- পালংশাক, লেটুসপাতা খেতে হবে। কারণ এটি ফাইব্রোমায়ালজিয়া নিরাময়ে ভূমিকা রাখে।

▶ পেঁয়াজ, রসুন, বাঁধাকপি, শসা, কমলালেবু এবং আপেল, যাতে রয়েছে সেলেনিয়াম যা এ রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

▶ দৈনিক কমপক্ষে আট গ্লাস পানি পান করা অত্যাবশ্যক ।

▶ চা-কফি এবং অ্যালকোহলজাতীয় পানীয় পরিহার করা। কারণ এগুলো রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করে।

▶ পরিমিত পরিমাণে লবণ খাওয়া। পাশাপাশি সোডিয়ামসমৃদ্ধ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য না খাওয়া।

লেখক : অধ্যাপক এবং ডিভিশন হেড, পেইন মেডিসিন ডিভিশন, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও চিফ কনসালট্যান্ট, ঢাকা পেইন ম্যানেজমেন্ট সেন্টার।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম