Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

গরমের বড় বিপদ হিট স্ট্রোক

Icon

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গরমের বড় বিপদ হিট স্ট্রোক

প্রতীকী ছবি

এখন গ্রীষ্মকাল, বাইরে বের হলেই কড়া রোদ। ইতোমধ্যেই সারা দেশে প্রচণ্ড তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে, গরম বেড়ে চলছে। দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। সারা দেশেই গরমে হাঁসফাঁস এবং নাভিশ্বাস অবস্থা, আর গরমের উৎপাতে দিশেহারা মানুষ এবং প্রাণীকুল। এ ছাড়া নানা রকম অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই।

* হিট স্ট্রোক কী

হিট স্ট্রোক বা সান স্ট্রোক এক ধরনের অসুস্থতা, যা অত্যধিক গরমের কারণে হয়। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে, শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, একে হিট স্ট্রোক বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। আমাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। গরম বাড়লে শরীরও ঘামতে শুরু করে, ঘাম বাষ্পীভূত হলে শরীর ঠান্ডা হয় এবং ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায়, ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং হিট স্ট্রোক দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রোকের আগে অপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক ‘হিট ক্র্যাম্প’ অথবা ‘হিট এক্সহসশন’ হতে পারে। হিট ক্র্যাম্পে শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা পায়। এরপরের ধাপে হিট এক্সহসশনে দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস, মাথাব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি দেখা দেয়। এ দুই ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর অত্যন্ত ঘামতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হিট স্ট্রোক হতে পারে।

* কার বেশি হয়

প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যে কারও হিট স্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

▶ শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন-উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার বা হার্টের রোগী, স্ট্রোক বা ক্যানসার, এমনকি যে কোনো কারণে যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে।

▶ যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন-কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক, ফুটপাতে বিভিন্ন কাজে যারা ব্যস্ত থাকেন।

▶ টানা রোদে অতিরিক্ত গরমে বেশিক্ষণ খোলা মাঠে খেলাধুলা ও ছোটাছুটি করলে, বিশেষ করে পানি কম পান করলে।

▶ গরম বাড়ার সঙ্গে এবং অন্য কোনো কারণে শরীরে পানিস্বল্পতা দেখা দিলে যেমন-অতিরিক্ত বমি বা ডায়ারিয়া হলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

▶ কিছু কিছু ওষুধ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় বিশেষ করে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ ডাইউরেটিক্স বিষণ্নতার, মানসিক রোগের ওষুধ ইত্যাদি।

* লক্ষণ

▶ শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়। অনেক গরম অনুভূত হয়, কিন্তু ঘাম বন্ধ হয়ে যায়। শরীরে হাত দিলে মনে হয় আগুন বের হচ্ছে।

▶ ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে যায়, নিশ্বাস দ্রুত হয়।

▶ নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, রক্তচাপ কমে যায়।

▶ খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্নতা ইত্যাদি।

▶ প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। রোগী শকেও চলে যায়। এমনকি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

* প্রতিরোধে করণীয়

গরমে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিট স্ট্রোকের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

▶ হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পড়ুন। সাদা বা হালকা রঙের এবং সুতি কাপড় হলে ভালো।

▶ যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন। বাইরে যেতে হলে মাথার জন্য চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করুন।

▶ বাইরে যারা কাজকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তারা মাথায় ছাতা বা মাথা ঢাকার জন্য কাপড়জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে পারেন।

▶ প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করুন। মনে রাখবেন, গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয় যেমন-খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদিও পান করতে হবে। পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে।

▶ তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী পানীয় যেমন-চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত।

▶ রোদের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এসব কাজ সম্ভব হলে রাতে বা খুব সকালে করুন। যদি দিনে করতেই হয়, তবে কিছুক্ষণ পরপর রোদ থেকে সরে গিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর লবণযুক্ত পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।

▶ যাদের শরীরে কোনো অসুখ আছে বা সারা দিনে প্রচুর ওষুধ খেতে হয়, তাদের দিনের চড়া রোদে না বেরোনোই ভালো।

▶ যারা দীর্ঘমেয়াদী বা অসংক্রামক রোগে ভোগেন যেমন-উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি বা লিভার ও ক্যানসারের রোগ ইত্যাদি তারা যথাসম্ভব বাইরের রোদ এড়িয়ে চলবেন।

▶ সবচেয়ে বড় কথা বিনা প্রয়োজনে এ সময় ঘরের বাইরে যাওয়া ঠিক নয়। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে গরম আবহাওয়া।

* আক্রান্ত হলে করণীয়

প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রেকের আগে যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই যা করতে পারেন-

▶ দ্রুত শীতল কোনো স্থানে চলে যান। যদি সম্ভব হয়, ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন। গায়ের কাপড় খুলে ফেলুন।

▶ ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করুন।

▶ প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। চা বা কফি পান করবেন না।

* আশপাশের লোকজনের করণীয়

যদি হিট স্ট্রোক হয়েই যায়, তবে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, ঘরে চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই।

▶ রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে নিয়ে যান। তার কাপড় খুলে দিন।

▶ শরীর পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে বাতাস করুন। এভাবে তাপমাত্রা কমাতে থাকুন। সম্ভব হলে কাঁধে, বগলে ও কুচকিতে বরফ দিন।

▶ রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে খাবার স্যালাইন দিন। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

▶ সব সময় খেয়াল রাখবেন হিট স্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং নাড়ি চলছে কি না। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। হিট স্ট্রোকে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে।

▶ গরমে শিশুদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি। বাচ্চাদের বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে। তারা যেন রোদের মধ্যে অনেক বেশি দৌঁড়ঝাঁপ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম