মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের রোগী কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে
ডা. তাহমীদ কামাল
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সাবএরাকনয়েড হেমোরেজ বা SAH হলো মস্তিষ্কের চারপাশে থাকা পাতলা আবরণ (Subarachnoid Space)-এ রক্তক্ষরণ হওয়া। সাধারণত এটি ব্রেইনের রক্তনালির ফেটে যাওয়া (Aneurysm Rupture) বা চোট লাগার কারণে হয়। এতে তীব্র মাথাব্যথা, বমি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি ইত্যাদি হতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই শুরু থেকেই দ্রুত পুনর্বাসন/ রিহ্যাবিলিটেশন চিকিৎসা জরুরি।
* প্রথম ধাপ : হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসা
প্রথমেই রোগীকে নিউরো-আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। এখানে মস্তিষ্কের চাপ (Intracranial Pressure) নিয়ন্ত্রণ করা হয়, রক্তচাপ ঠিক রাখা হয় এবং বিশেষ ওষুধ Nimodipine দিয়ে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে সংকোচন (Vasospasm) প্রতিরোধ করা হয়। প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করে রক্তপাত বন্ধ করা হয়। এ সময় রোগীকে সঠিক ভঙ্গিতে শুইয়ে রাখা, অক্সিজেন দেওয়া এবং নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
* শুরু থেকেই হালকা ব্যায়াম
রোগী স্থিতিশীল হলে যত দ্রুত সম্ভব (সাধারণত ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে) হাত-পায়ের হালকা ব্যায়াম শুরু করা হয়। প্রথমে ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করিয়ে দেন যাতে পেশি শক্ত হয়ে না যায় এবং রক্ত জমাট না বাঁধে। এতে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় এবং দ্রুত সেরে ওঠা শুরু হয়।
* জটিলতা প্রতিরোধ
দীর্ঘদিন শুয়ে থাকলে অনেক সমস্যা হতে পারে, যেমন রক্ত জমাট বাঁধা (DVT), নিউমোনিয়া, বেডসোর ইত্যাদি। এসব এড়াতে বিশেষ সাপোর্ট সিস্টেম, পায়ের মোজা, পায়ের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। নিয়মিত অবস্থান পরিবর্তন করা হয় এবং শ্বাসপ্রশ্বাস ভালো রাখতে বুকের ব্যায়াম করানো হয়।
* কথা বলা ও গিলতে পারার থেরাপি
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে কথা বলা বা গিলতে সমস্যা হতে পারে। তাই Speech-Language Therapist রোগীর ভাষা অনুশীলন, গিলতে শেখানোর ব্যায়াম করান। এতে রোগী আবার ঠিকভাবে কথা বলতে ও খাওয়া শুরু করতে পারেন।
* দৈনন্দিন কাজ শেখা (Occupational Therapy)
রোগীর আবার নিজের কাজ যেমন খাওয়া, পোশাক পরা, গোসল করা, হাঁটা ইত্যাদি শিখতে হয়। অকুপেশনাল থেরাপিস্ট বিশেষ যন্ত্রপাতি ও কৌশলের সাহায্যে রোগীকে এসব শেখান। প্রয়োজনে বাসা-বাড়িও রোগীর জন্য নিরাপদ করে সাজানো হয়।
* রোবটিক ও প্রযুক্তি সহায়তা
এখন অনেক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। যেমন, রোবটিক ওয়াকিং মেশিন দিয়ে হাঁটা শেখানো, হাতে পায়ে ইলেকট্রিক স্টিমুলেশন দিয়ে পেশি সচল করা, এমনকি ভার্চুয়াল রিয়ালিটি গেম দিয়ে ভারসাম্য অনুশীলন করানো হয়। এসব প্রযুক্তি রোগীর পুনর্বাসন দ্রুত করে।
* মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা
রোগীরা অনেক সময় হতাশা, উদ্বেগ বা স্মৃতিশক্তি সমস্যায় ভোগেন। এজন্য সাইকোলজিস্ট ও নিউরোসাইকোলজিস্ট রোগীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন। এতে রোগী আত্মবিশ্বাস ফিরে পান এবং দৈনন্দিন জীবনে সক্রিয় হন।
* দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ও সমাজে ফেরা
৬ সপ্তাহ পর থেকে রোগীকে সমাজে ফেরানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন কাজের জায়গায় ফেরার পরিকল্পনা, গাড়ি চালানোর সক্ষমতা যাচাই ও প্রয়োজন হলে নতুন চাকরি শেখানো। যাদের স্থায়ী শারীরিক সীমাবদ্ধতা আছে, তাদের জন্য হুইলচেয়ার বা স্মার্ট হোম ডিভাইস ব্যবহার করা হয়।
* নতুন গবেষণা ও উদ্ভাবন
আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দিয়ে ব্যায়ামের পরিকল্পনা, মস্তিষ্ক থেকে সংকেত নিয়ে পেশি নড়ানোর প্রযুক্তি (Brain-Computer Interface), এবং অনলাইনে ঘরে বসে রিহ্যাব করার সুযোগ (Tele-rehabilitation) চালু হয়েছে। এ ছাড়া স্টেম সেল থেরাপি নিয়ে গবেষণা চলছে।
সাবএরাকনয়েড হেমোরেজের পর সুস্থ হতে সময় লাগে, কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ও মাল্টিডিসিপ্লিনারি রিহ্যাব প্রোগ্রামের কারণে এখন রোগীরা আগের তুলনায় অনেক দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। পরিবার ও চিকিৎসকের সমন্বিত সহায়তা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ।
