Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

মানুষের পাশে জিলিয়ানের চার দশক

Icon

তোজাম্মেল আযম

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের আলো ফোটার আগে বল্লভপুরের নিঃশব্দ অরণ্যে যখন পাখিরা ডানা ঝাপটাতে শুরু করে, তখন সবার আগে জেগে ওঠেন এক নারী। তিনি জিলিয়ান এম রোজ। নয় দশক ছুঁই ছুঁই বয়স, তবু মানবতার দায় তাকে জাগিয়ে তোলে। প্রার্থনা কক্ষের মেঝেতে মাদুর পেতে বসে তিনি চোখ বন্ধ করেন। মুখে কোনো শব্দ নেই, শুধু ঠোঁট লড়ে। মনে হয়, পৃথিবীর ব্যস্ততার ঠিক উলটোদিকে বসে আছেন কেউ, যার কাছে সবকিছু নীরবতার মতোই স্বচ্ছ।

বল্লভপুর মেহেরপুর জেলার এক সীমান্ত গ্রাম। এখানেই গত চার দশকের বেশি সময় ধরে নিজের দেশ, পরিবার, ভবিষ্যৎ আর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে বসবাস করছেন জিলিয়ান। একজন ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি ভালোবেসেছেন বাংলাদেশকে, জীবন উৎসর্গ করেছেন মানবসেবায়।

জিলিয়ান রোজের বাংলাদেশে আগমন ১৯৬৪ সালে। মূলত ধর্মীয় মিশনের অংশ হিসাবে আসা। তবে এ মাটির মানুষ তাকে আকৃষ্ট করে ভিন্নভাবে। ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি দেখতে পান; এ দেশে মানুষের যন্ত্রণা, রোগ-শোক, দারিদ্র্য, আর অবহেলা। আর তখনই শুরু হয় এক ভিন্ন জীবনের গল্প। নার্সিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তিনি যুক্ত হন দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ খ্রিষ্টান পল্লি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুর এলাকার স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে।

১৯৮১ সালে বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে নার্স হিসাবে তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। শুরুতে সবকিছুই ছিল অগোছাল। যন্ত্রপাতির অভাব, লোকবলের ঘাটতি, ওষুধের সংকট-এসব কিছুর মাঝেই তিনি কাজ শুরু করেন। পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশকে এ হাসপাতাল শুধু চিকিৎসার স্থান নয়, হয়ে ওঠে মানুষের আশ্রয়স্থল। গরিব, অসহায়, বঞ্চিত মানুষের জন্য ‘রোজ সিস্টার’ হয়ে ওঠেন নির্ভরতার প্রতীক। মানুষের সেবা দিতে গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয়নি। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই) যোগ্যতা অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে সেই পুরস্কার নিতে হয়। কিন্তু মেহেরপুরের মানুষকে ভালোবেসে সে পুরস্কার নিতে যাওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে তৎকালীন ইংল্যান্ডের রানির পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন হাইকমিশনার ডেভিড কার্টার মেহেরপুরের বল্লভপুরে আসেন। এক অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে ওবিই (অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার) উপাধি দিয়ে তাকে সম্মানিত করেন।

সুরঞ্জনার সঙ্গে আলাপচারিতায় রোজ সিস্টারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনার চোখে বল্লভপুর কেমন? এত বছর পরও, আজও?

রোজ সিস্টার গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘বল্লভপুর আমার কাছে শুধু একটি স্থান নয়। এখানকার প্রতিটি দুঃখী মুখ প্রার্থনার মতো প্রশান্তি দেয় মনে। অনেকে শহরে যায় সুখ খুঁজতে, আমি এসেছিলাম দুঃখ খুঁজতে। কারণ দুঃখ ছাড়া ঈশ্বর ধরা দেন না। এখানে আমি তাকে পেয়েছি প্রতিটি অসুস্থ শিশুর চোখে, প্রতিটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার নিশ্বাসে।’

জানতে চাইলাম, ‘আপনি যখন প্রথম এসেছিলেন, ভয় লাগেনি? ভাষা না জানা, সংস্কৃতি না চেনা এক ভিন্ন দেশে?’

জিলিয়ান রোজ হেসে বললেন, ‘ভয়ের অনেক রূপ আছে। ভয় তখনই ভয়, যখন হৃদয়ে আত্মবিশ্বাস না থাকে। আমি এসেছিলাম বিশ্বাস নিয়ে-মানবতা সব ভাষার ওপরে, সংস্কৃতির ওপরে। বাংলা ভাষা শিখেছি ভালোবাসা দিয়ে। ভুল করেছি, মানুষ হেসেছে, কিন্তু সে হাসির মধ্যেও ছিল আদর, গ্রহণযোগ্যতা।’

‘আপনার নিজের দেশ, পরিবার, আপনজন-মিস করেন না?’

চোখ মেলে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাকে সত্যিকারের ভালোবাসা বলা যায়, সে একই সময়ে আত্মত্যাগ এবং পূর্ণতা? আমার পরিবার আমার হৃদয়ে আছে, কিন্তু এ মাটির ধুলোতে আমি যেসব মুখের যন্ত্রণা মুছেছি, তারা হয়ে উঠেছে আমার আত্মার আত্মীয়। আকাশের তারা যেমন দূরে থেকেও আলো দেয়, আমার আপনজনরাও তেমন, কিন্তু এ পৃথিবীর আলো আমি এখানেই খুঁজে পেয়েছি।’

‘জীবনে কখনো কি মনে হয়েছে, আমি ভুল করলাম? এত বড় ত্যাগ! সংসার করলেন না, সন্তানও নেই।’

‘সন্তান? আমি তো একবার গুনেছিলাম-এ হাসপাতালে আমার হাতে ৪ হাজার ২০০ শিশুর জন্ম হয়েছে। তাদের কান্না, হাঁটা, স্কুলে যাওয়া সবই আমি দেখেছি। তুমি বলো, এর মধ্যে কোনোটি কি আমার সন্তান নয়? সংসার? একজন মানুষের সারা জীবন যেন একটা পাত্র। কে কী দিয়ে ভরবে, তা তার ব্যাপার। আমি ভরেছি করুণা, প্রার্থনা, আর মানুষের প্রতি মমতা দিয়ে।’

‘আপনার শেষ ইচ্ছা কী?’

‘একটি গাছ। যেখানে আমার দেহ রাখা হবে, সেখানে একটা গাছ লাগিয়ে দিয়ো। শিশুরা যাতে তার ছায়ায় খেলে, পাখিরা বাসা বাঁধে। আমি চেয়েছিলাম মানবতা বাঁচুক, ভালোবাসা বাঁচুক। আমার না থাকাও যদি সেই আলোয় এক বিন্দু হয়-তবেই জীবন সার্থক।’

ভোরের আলো মিশন হাসপাতালের টিনের ছাউনি থেকে রোদের ছায়া গড়িয়ে পড়ছে। একজন তরুণ নার্স দৌড়ে এসে জানায়-সিস্টার, ওয়ার্ডে একজন রোগীর অবস্থা খারাপ।

রোজ সিস্টার কোনো নির্দেশ দেন না, বরং ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকেন। যেন প্রতিটি পা ফেলা একেকটা সিদ্ধান্ত। পাশ থেকে লক্ষ করি-এই বৃদ্ধা নারীর চেহারায় নেই কোনো ভয়, নেই ক্লান্তির ছাপ। হাসপাতালের করিডর যেন তার তপোবনের পথ।

রোগীর বিছানায় বসে রোজ জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার মায়ের নাম কী?’ রোগী অবাক হয়ে বলে, ‘কেন?’

‘কারণ এই মুহূর্তে আমি তোমার মা হয়ে যাচ্ছি। মা’র মতো ভালোবাসা দিলে শরীরও ভালো হয়, মনও।’

তারপর তিনি নিজ হাতে ভিজিয়ে দেন কাপড়, মাথায় ঠান্ডা পানি দেন। জিলিয়ান নিজে খাবার খান না, যতক্ষণ না বৃদ্ধাশ্রমের সব মানুষ খেয়ে নেন।

এক বৃদ্ধা এসে বলেন, ‘মা, তুমি খাবে না?’

রোজ বলেন, ‘মা আগে খেলে মেয়েও খায়। আমি তো এখন তোমাদের মেয়ে!’

বৃদ্ধার প্রশ্নের উত্তরে রোজের এই একটি বাক্য যেন এক মহাকাব্য। কখনো মা, কখনও মেয়ে, কখনও ডাক্তার, কখনও প্রার্থনায় মগ্ন-রোজ সিস্টার যেন একা নন, তিনি এক বহুরূপী ভালোবাসার প্রতিরূপ।

জানতে চাইলাম, ‘মানুষের এত কষ্ট দেখেন-কখনো কি মনে হয়, আপনি সবকিছু পারবেন না?’

বললেন, ‘পাহাড়ও নদীর সামনে নত হয়। আমি হয়তো কিছুই পারি না, কিন্তু আমি পাশে থাকি। এই পাশে থাকা-এটাই অনেক সময় ওষুধের চেয়েও বেশি কাজে দেয়।’

রাত যখন ৯টা রোজ সিস্টার হাঁটেন শেষ রাউন্ডে। সবার বিছানার চাদর টান করে দেন, ওষুধের সময়টা দেখে নেন। তারপর নিরিবিলি উঠে যান নিজের ঘরে। বল্লভপুরের মানুষদের চোখে রোজ সিস্টার তাদের স্মৃতি, কৃতজ্ঞতা, চোখ ভেজানো কথাগুলো, যেগুলো হয়তো কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের চেয়েও বেশি মূল্যবান।

বল্লভপুরের বাতাসে একটা আলাদা গন্ধ আছে। মানবতার গন্ধ। এখানকার স্কুলপড়ুয়া শিশু, নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা, খেটে খাওয়া কৃষক, বিয়ের পর প্রথম সন্তানসম্ভবা নারী-সবার জীবনেই একবার না একবার এসে পড়েছে একটি নাম : রোজ সিস্টার। তাদের কণ্ঠে রোজ সিস্টারের প্রতিচ্ছবি।

বল্লভপুরের ৭৩ বছরের বৃদ্ধ দিনমজুর মালেক চাচা বলেন, ‘১৯৮৩ সালের কথা, আমার বউয়ের প্রসব বেদনা শুরু হয়। চারদিকে কেউ নেই, হাসপাতাল জেলা সদরে। হঠাৎই সাদা জামা পরা এক মেয়ে এসে হাজির। নিজেই ঘর মোছা থেকে শুরু করে, গরম পানি আনিয়ে, হাতে ধরে আমার ছেলেটাকে দুনিয়ায় আনল। সেই ছেলে এখন শিক্ষকতা করে। আমি এ স্মৃতি ভুলতে পারি না। ভুলে গেলে মনে হয় অবিচার হয়।’

স্থানীয় গৃহবধূ হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘আমি গর্ভকালীন জটিলতায় ভুগছিলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পয়সা নেই, ওষুধ কেনার ক্ষমতা নেই। রোজ সিস্টার তার নিজের টাকা দিয়ে ইনজেকশন আনালেন। একরকম রাতভর জেগে বসে থাকলেন আমার পাশে। তার চোখে ঘুম ছিল না, শুধু মমতা ছিল। আমি এখন সন্তানসহ সুস্থ। আমার ছেলের নাম রেখেছি জিলান। তার নামের মতোই আলোয় বড় হোক আমার সন্তান।’ স্থানীয় এক ইমাম সাহেবের বয়ানে-ধর্ম ভিন্ন, বিশ্বাস আলাদা। কিন্তু রোজ সিস্টার এমন একজন, যাকে আমরা ধর্মের সীমায় ফেলতে পারি না। যখন তিনি আজানের সময় চুপ থেকে শ্রদ্ধা জানান, তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার হৃদয় ভরে ওঠে।

ছয় বছরের শিশু অনিকা জানায়-রোজ সিস্টার আমায় চকলেট দেন, তারপর বলেন-ভালো মেয়ে হতে হয়, মিথ্যে বলা ঠিক নয়। আমি আর মিথ্যে বলি না।

দেশে যেতে ইচ্ছা করে না এমন প্রশ্নে স্মৃতিচারণ করে রোজ বলেন, ‘আমি শেষবার ১৯৭০ সালে মাকে জড়িয়ে ধরি। তারপর আর দেখা হয়নি। চিঠি আসত মাঝে মাঝে, কিন্তু তারপর একদিন খবর আসে মা আর নেই। আমি ওর কবরেও যেতে পারিনি। শুধু এক জোনাকি রাতে হাঁটছিলাম বল্লভপুরে। আমার মায়ের কথা মনে পড়তেই মাটি ছুঁয়ে বলেছিলাম-মা, এ মাটিই তোমার জন্য রেখেছি। জন্মভূমিতেও আর যাওয়া হয় না। আমি কোনো গির্জার প্রয়োজন অনুভব করি না। এ হাসপাতালের প্রতিটি বিছানা, হাসি-কান্না-এটাই আমার ঠিকানা, আমার উপাসনালয়।’

‘আপনার মৃত্যুর পর কী চান?’ এমন প্রশ্নে তার চোখ অনেকক্ষণ নীরব ছিল। তারপর ধীরে বলেন, ‘এ হাসপাতালের পেছনে একটা ছোট্ট জায়গা আছে। যেখানে আমি বসতাম। চাই, মৃত্যুর পর সেই গাছটার ছায়ায় আমাকে শুইয়ে দিও। যেন প্রতিদিনের সকাল-সন্ধ্যা রোগীদের কণ্ঠস্বর আমার সমাধি পর্যন্ত আসে। যেন আমি থেকে যাই নিঃশব্দ সেবায়। দামি কফিনে নয়, শুধু সাদা কাপড়ে মুড়ে দিও আমায়। যেন একজন গরিব নারীও জানতে পারে তার মতোই আমিও বিদায় নিয়েছি। শুধু একটা ছোট্ট পাথরে লিখে দিও-তিনি ভালোবেসেছিলেন, আর ভালোবেসে থেকেই গেলেন।

রোজ সিস্টার হয়তো চলে যাবেন একদিন, কিন্তু বল্লভপুরে যখন বাতাস বইবে, জারুল গাছের নিচে কেউ দাঁড়াবে, তখনো শোনা যাবে-এ হাসপাতালের প্রতিটি বিছানা, হাসি-কান্না-এটাই আমার ঠিকানা, আমার উপাসনালয়।

জিলিয়ান একজন নিবেদিত প্রাণ সেবিকা। মানুষের সেবায় ক্লান্ত হন না। দেশ, জাতি, বর্ণ কিংবা ধর্ম কোনো কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। এ মাটির গন্ধে, মানুষের চোখের ভাষায় তিনি খুঁজে পেয়েছেন নিজেকে। তার হাতে গড়া বল্লভপুর মিশন হাসপাতাল এখন হাজারো মানুষের নির্ভরতার ঠিকানা। আশপাশের গ্রামের গরিব মানুষদের কাছে তিনি ‘রোজ সিস্টার’ নামে পরিচিত একজন নির্ভেজাল মানুষ, যার কোনো চাওয়া নেই, শুধু নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা বিলানো ছাড়া।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম