পদ্মার চরে নারীর অবিরাম জীবনযুদ্ধ
মতিউর রহমান, মানিকগঞ্জ থেকে
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পদ্মা কখনো শান্ত, কখনো মাতৃহৃদয়ের মতো। আবার কখনো সে নিষ্ঠুর। গিলে ফেলে শতাব্দীর স্মৃতি, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি। নিঃস্ব করে দেয় পরিবার। ভাঙন, সরে যাওয়া, আবার নতুন করে দাঁড়ানোর অনন্ত চক্রে ঘুরপাক খায় পুরো জনপদ। আর এ পরিবর্তনশীল, ভগ্ন মানচিত্রের মাঝেই অদম্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন পদ্মার চরাঞ্চলের নারীরা।
আর ঠিক এ নদীর তীরে, বালুর বিশাল চরে, প্রকৃতির প্রতিদিনের পরীক্ষায় উতরে দাঁড়িয়ে আছেন একদল নারী। অদম্য, দৃঢ়, অবিচল চরাঞ্চলের এ নারীরা।
মানিকগঞ্জের ভৌগোলিক মানচিত্রেই শুধু প্রাচীন জনপদ সেলিমপুর, পাটগ্রামচর, নটাখোলা, আন্ধারমানিক। প্রমত্তা পদ্মার করাল গ্রাসে গ্রামগুলো গিলে ফেলেছে অনেক আগেই। কিন্তু কালের বিবর্তনে ওই ভাঙনকবলিত গ্রামগুলো আবারও জেগে উঠেছে। সেখানে নতুন করে বসতি গড়ে তোলে সেখানকার আদি বাসিন্দারাই। কিংবা তাদের প্রজন্মের কেউ। কিন্তু বর্তমানে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌযান। ইঞ্জিনচালিত নৌকা হচ্ছে তাদের ভরসা। বৈরী আবহাওয়া থাকলে গ্রামগুলোর মানুষ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকে। কিন্তু এ চরের নামগুলো আসলে সংগ্রাম, সহনশীলতা আর বেঁচে থাকার গল্পের প্রতীক। এখানে প্রতিটি ভোর, দুপুর, বিকাল আর রাত-নারীদের ঘাম, পরিশ্রম, প্রাণান্ত লড়াই আর স্বপ্নবন্দি দিনের বর্ণনায় মুখর যেন।
সেলিমপুরের বিলকিস আক্তার যখন দরজা খুলে বাইরে পা রাখেন, সূর্য তখনো দিগন্তে ওঠেনি। কুয়াশা আর পদ্মার ঠান্ডা বাতাস চুলে লেগে যেন বলে আজকেও লড়াই আছে। হাতে কাস্তে, কাঁধে বস্তা, খালি পায়ে বালুর ওপর বিদ্যমান শীতল ব্যথায় হাঁটা-এটাই তাদের সকালের দৃশ্য। বিলকিসের ছোট্ট উঠানটি যেন এক ক্ষুদ্র যুদ্ধক্ষেত্র। গোয়ালঘর পরিষ্কার, খড়কুটো তোলা, শিশুদের নাশতা বানানো, স্বামীর জন্য ভাত রেখে যাওয়া-এসব করা শেষ হলে তিনি বালুর চরের পথে হাঁটতে হাঁটতে মিশে যান অন্য বিলকিসদের সঙ্গে। তারা জানেন-এ ভোর আলস্য নয়, এ ভোর বেঁচে থাকার।
চরের দুপুর মানেই তপ্ত রোদ, বালুর দহন, কাইশ্যা-নলখাগড়ার কাঁটাযুক্ত বন, আর অনবরত যাত্রা। এগুলো কোনো বাধা নয়, বরং প্রতিদিনের দায়িত্ব। নদীর ধারে, কাশবনে-যেখানে ঘাস আছে, সেখানেই তারা ছুটে যান।
গঙ্গাধরদি গ্রামের বিথী বেগমের কথায় ফুটে ওঠে বাস্তবতা, ‘আগে এত কষ্ট আছিল না। ঘাসের কমতি ছিল না। এখন জমি নদী খাইয়া ফেলছে। মানুষ আবাদ করে ফেলছে, বিষ দিচ্ছে। গরু পালা খুব কঠিন হইয়া গেছে।’ চরের এ নারীরা জানেন-গরু বাঁচানো মানে ঘর বাঁচানো।
চরের মেয়েদের শৈশব মানে দায়িত্ব। অথচ এ বয়সে বই-খাতা নিয়ে স্কুলের আঙিনায় মুখরিত থাকার কথা তাদের। সহপাঠীদের সঙ্গে হৈহুল্লোড় করে সময় কাটানো বাদ দিয়ে সাত-আট বছরেই চরের শিশুরা মা-বাবার কাছ থেকে শেখে গরু, ছাগল, ভেড়া চরানো, খড় সংগ্রহ, কাস্তে চালানো। তাদের বিকাল মানে লুকোচুরি খেলা নয়-ধুলা, চোরাবালি আর গবাদিপশুর ছায়া। স্কুল আছে, কিন্তু স্বপ্ন নেই। স্কুলে যাওয়াটাকে পরিবারের বেশির ভাগই মনে করেন ‘অযথা খরচ’। কৈশোর পেরিয়ে যেতে না যেতেই বিয়ের পিঁড়ি; তারপর শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। স্বামী, সন্তান, সংসার, আর গবাদিপশু-সব দায়িত্ব এক কাঁধে। কিশোরী মন স্বপ্ন দেখার আগেই নারী হয়ে ওঠে, দায়িত্বে চূর্ণ হয়ে যাওয়া চরাঞ্চলে এ রীতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলছে।
পড়ন্ত বিকালে দেখা যায় নারীরা গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছেন। যেন তারা ফিরছেন এক অসীম যুদ্ধ শেষে। তবে এ পশুরাই তাদের আশ্রয়, সঞ্চয়, বিশ্বাস। একটি দুধেল গাভি মানে-সন্তানের স্কুলের ফি, রান্নার খরচ, সংসারের জরুরি চিকিৎসা, বন্যায় বাড়ি ভেসে গেলে আবার তৈরি করার শক্তি।
চল্লিশোর্ধ্ব আলেয়া বেগম বলেন, ‘গরু বাঁচাইতে গিয়া আমাগো জীবনটাই দিয়া দিই। গরু বাঁচলে বাড়িটা বাঁচে।’ পদ্মা পাড়ে বর্ষাকালে প্রতি রাতে যখন পদ্মা গর্জে ওঠে, তখন চরাঞ্চলের নারীরা ঘুম ভুলে যায়। রাতে চরাঞ্চলের ভাঙন ভয়ংকর! নদীর তীব্র স্রোত হঠাৎ গর্জন করলে নারীরা ছুটে যান গোয়ালঘরের দিকে। গরু ঠিক আছে তো? ঘরটা টিকবে তো? তারা জানেন-আজ যে জমিতে দাঁড়িয়ে আছেন, কাল সেটি নদীর তলায় মিলিয়ে যেতে পারে।
এই নারীরা বীজ শুকান, ধান ওল্টান, মাঠে হাতে-হাত রেখে পুরুষের কাজে সাহায্য করেন, দুধ বিক্রি করেন, গবাদিপশু লালন-পালন করেন-কিন্তু তাদের পরিশ্রমের হিসাব লেখা হয় না কোনো বইতে। বাংলাদেশের অর্থনীতির গভীরে এ অদৃশ্য শ্রম প্রতিদিন প্রবাহিত হয় নীরবে, অথচ দৃঢ়ভাবে।
চরাঞ্চলের নারীরা কোনোদিন পরাজয় মানেন না। বালুর বুকে দাঁড়িয়ে, স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে, ভাঙনের দাগ হৃদয়ে নিয়েও তারা বেঁচে থাকেন। তারা তত্ত্ব জানেন না, পরিকল্পনা বোঝেন না, রাষ্ট্রীয় বাজেটের অঙ্ক জানেন না। কিন্তু জানেন একটাই সত্য-গরু-ছাগল বাঁচলে সংসার বাঁচে, সংসার বাঁচলে জীবন বাঁচে। চরাঞ্চলের এই নারীরা শ্রমে, শক্তিতে, অবিচল মনোবলে নিজেদের জীবন দিয়ে মহাকাব্য রচনা করে যাচ্ছেন প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে।
