দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণের সহযাত্রী ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন
ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন। অসহায়, হতদরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাওয়া বাতিঘর। বৈমানিক ফারিয়া লারা এসব দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণের সহযাত্রী ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। তার স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন হতদরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করছে ২০০৩ সাল থেকে। সেসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন-শিল্পী নাগ
প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সুমাইয়ার রোল নম্বর এক। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। বরগুনার বামনা থানার ডৌয়াতলা গ্রামের হলতা ডৌয়াতলা সমবায় বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। পড়াশোনায় মেধাবী হলেও ওর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। মা চায়না বেগম ভিক্ষে করে সংসার চালায়। দেড় মাস বয়সে বাবা মো. হাশেম শেখকে হারায় সুমাইয়া। সহায়-সম্বলহীন বিধবা মা নিজের ও মেয়ের খরচ চালাতে চিটাগাংয়ের একটি গার্মেন্টে চাকরি নেন। মেয়ের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে মা কষ্টের মধ্যেও চিটাগাং ক্যাডেট স্কুলে প্লে গ্র“পে ভর্তি করিয়ে দেন। ওই স্কুলে কেজি পর্যন্ত পড়ে সুমাইয়া। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের কারণে চলে আসে বরগুনার ছনবুনিয়া গ্রামে। ডৌয়াতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বছর দুয়েক আগে মাকে ছেড়ে চলে যান ওর সৎ বাবা। দেড় বছরের ছেলেসহ ওর মা আর ওকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ওর মা ওদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে ওঠেন জাফ্রাখালির সরকারি আবাসনের একটি খালি ঘরে। এত কষ্টের মধ্যেও পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও অংশ নেয়। ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে উপস্থিত বক্তৃতায় অংশ নিয়ে প্রথম হন সুমাইয়া। ও স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হওয়ার। ওর সেই স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করছে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন।
এ প্রসঙ্গে সুমাইয়া বলে, ছোট ভাইকে দেখাশোনার কেউ না থাকায় মা চাকরি করতে পারেন না। এর-ওর কাছে চেয়েচিন্তে আমাদের বড় করছেন। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতে না পেলেও পড়াশোনা ছাড়তে রাজি নই আমি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে আমি হলতা ডৌয়াতলা সমবায় বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। শিক্ষকরা আমার ভালো ফলাফল দেখে ভর্তি ফি, বেতন মওকুফ করে দেন। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত আমি ক্লাসে দ্বিতীয় হতাম। অষ্টম শ্রেণীতে প্রথম হই। এর পেছনেও কারণ আছে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে আমি ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন থেকে শিক্ষা উপবৃত্তি পাই প্রতি তিন মাস পর ৮০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে বই-খাতা, কলম, স্কুলের ড্রেস কিনে দিয়েছেন মা।
এবার বরগুনার হলতা ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন মার্জিয়া আখতার। অবুঝ বয়সে ওদের দুই ভাইবোনকে বাবার কাছে রেখে চলে যান মা। বাবা ঢাকার একটি মাদ্রাসার পিয়ন। মায়ের চলে যাওয়ার পর ওর বাবা আবার বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। বাবার সঙ্গে মার্জিয়া ঢাকায় থাকতে চাইলেও রাজি হননি বাবা। ওর ছোট ভাই বাবার সঙ্গে থাকে। অবশেষে ওর ঠাঁই হয়েছে দাদির কাছে।
দাদির কাছে থেকে পড়াশোনা করতে কেমন লাগছে জানতে চাইলে বরগুনার বড়তালেশ্বর গ্রামের মেয়ে মার্জিয়া আখতার বলেন, মা আমাদের দুই ভাইবোনকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় প্রায়ই দাদি, কাকা কথা শোনায়। বলেন বিয়ে দিয়ে দেবেন আমায়। ওদের কথায় খুব মন খারাপ হয় আমার। মনের কষ্টে একসময় পড়াশোনা করতে ইচ্ছা করে না। আব্বা আমাকে পড়তে বলেন। তখনই আবার পড়াশোনায় মন দিই। এসব কারণে এসএসসি পরীক্ষায় আমি প্রত্যাশিত ফলাফল করতে পারিনি। দাদি, কাকা মাকে নিয়ে আজেবাজে কথা শুনালেও আমাকে আদরও করেন। ভালোও বাসেন। আব্বার একার আয়ে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের কলেজের কেমিস্ট্রির শিক্ষক বাবুল গোমস্তা আমাকে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনের শিক্ষা উপবৃত্তির খবরটা দেন গত বছর। এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ার সময়ে আমি এই শিক্ষা উপবৃত্তি পাওয়ার জন্য পরীক্ষায় অংশ নিই। আমার সঙ্গে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষা উপবৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। ২০১৭ সালে জুন থেকে আমি তিন মাস পরপর এক হাজার টাকা শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছি। এই টাকা দিয়ে আমি বই কিনেছি।
ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার হোসেন খানের মতে, ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন হতদরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ২০০৩ সালে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামভিত্তিক শিক্ষা উপবৃত্তি চালু করে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বার্ষিক পরীক্ষায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতায় হতদরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। যারা প্রথম হন তাদের এই শিক্ষা উপবৃত্তি দেয়া হয়। কখনও কখনও প্রথম-দ্বিতীয় দু’জনকেই দেয়া হয়। বরগুনার হলতা ডৌয়াতলা সমবায় বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আট মেধাবী শিক্ষার্থীকে মাথাপিছু প্রতি তিন মাস পর ৮০০ টাকা, হলতা ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজের আট শিক্ষার্থীকে মাথাপিছু তিন মাস পর ১ হাজার টাকা, ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এক শিক্ষার্থী, বরগুনার লেম্বুয়া কলেজের দুই শিক্ষার্থী ও বরগুনা সরকারি কলেজের এক শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী, বরিশাল মেডিকেল কলেজের দুই শিক্ষার্থী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থী প্রত্যেককে তিন মাস পর দুই হাজার টাকা শিক্ষা উপবৃত্তি দেয়া হয়। এ বছর ২৫ শিক্ষার্থী নির্বাচিত হয়েছে শিক্ষা উপবৃত্তি পাওয়ার জন্য।
