মেয়েকে গড়ে তুলুন দায়িত্বশীল হিসাবে
রীতা ভৌমিক
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অভিভাবকদের অসচেতনতা বা সন্তানকে সময় না দেওয়ার কারণে অল্প বয়সে ছেলেমেয়েরা প্রেমঘটিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে তারা অল্প বয়সে ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবেও বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই পাত্রস্থ করে। এভাবেও মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। লিখেছেন-রীতা ভৌমিক
চার ও দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলেন ষোলো বছরের মর্জিনা। কয়েকদিন ধরে তার শরীর থেকে ব্লাড যাচ্ছে। আর মেয়েরা জ্বরে ভুগছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে মর্জিনা থাকেন ঢাকার যাত্রাবাড়ীর ধলপুরের ছিয়ানব্বই ঘর স্টাফ কোয়ার্টারের ভাড়া বাসায়। স্বামী ভ্যান গাড়িতে ময়লা নেয়। বারো বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেন মর্জিনা। স্বামীর বয়স তখন ষোলো।
মর্জিনার মতে, ছোট ভাই গ্রামের বাড়িতে পানিতে পড়ে মারা যায়। ভাই মারা যাওয়ায় মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। বাবা কুমিল্লা থেকে আমাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। আমার বয়স আট-নয় বছর হবে। আমি একা হওয়ায় বাবা-মা আমাকে কিছুই বলতেন না। ছোট্ট একটি ঘর ভাড়া নিয়ে আমরা থাকতাম। বাবা শাক বিক্রি করতেন আর মা বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। আলাদা রান্নাঘর ছিল না। গ্যাসের চুলা ছিল না। মা সারা দিন অন্যের বাড়িতে কাজ করায় কোনো কোনো দিন রান্নার সময় পেতেন না। আমি ধলপুরে আদর্শ এলাকায় যেতাম ভাত, তরকারি রান্না করে নিয়ে আসার জন্য। সেখানে আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়। যে বাড়িতে রান্না করতে যেতাম সেটা ছিল ওর বড় বোনের বাড়ি। ও বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসত। এভাবে দিনের পর দিন দেখা হতে হতে আমাদের প্রেম হয়ে যায়। মা-বাবা বাসায় না থাকলে ও আমাদের ঘরে আসত। কিছু না বুঝে আমরা শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। তিন মাস পর বুঝতে পারি বাচ্চা পেটে। দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের বিয়ে হয়। প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। এর দুবছর পর আবারও গর্ভবতী হই। দ্বিতীয় সন্তানও মেয়ে। বয়স কম হওয়ায় আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বুঝতে পারিনি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি নিতে হবে। এ সম্পর্কে ধারণাও ছিল না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাসটার সার্ভে ২০১৯ অনুসারে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সি মেয়েদের ৫১ দশমিক ৪ শতাংশের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়। ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হয় ১৫ শতাংশের।
ইউনিসেফের ‘ইন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ এ প্রোফাইল অব প্রোগেস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২০২০ সালের অক্টোবরের আরেকটি গবেষণায় জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বাল্যবিয়ে হারে শীর্ষে রয়েছে।
করোনাকালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বাল্যবিয়ের ওপর ২১ জেলায় গবেষণা করে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সি ১৩ হাজার ৮৮৬ মেয়ের বাল্যবিয়ের তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে ৭৮ শতাংশের বাল্যবিয়ে হয়েছে অভিভাবকের ইচ্ছায়।
বাংলাদেশের আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর? ছেলেদের ২১ বছর। এর কম বয়সি মেয়েদের বিয়ে হলে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ? কিন্তু আইনের বিধিনিষেধ কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে এটি বন্ধ হচ্ছে না?
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বাল্যবিয়ের প্রথম কারণ দারিদ্র্য? দ্বিতীয়ত অভিভাবকদের অসচেতনতা? অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে অল্প বয়সে কৌতূহলের বশে ছেলেমেয়েরা ভুল করে ফেলে। সেই ভুল শোধরানোর জন্য বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া গ্রামে বা শহরে দরিদ্র বা অল্প শিক্ষিত পরিবারেই যে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে, তা নয়? শহরে অনেক শিক্ষিত পরিবারেও বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে? অনেক সময় দেখা যায়, বিদেশে পড়ালেখা করে এমন ছেলেমেয়ের বয়স বিবেচনা না করেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় অভিভাবকরা?
তিনি আরও বলেন, শারীরিকভাবে উপযুক্ত হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দেওয়ায় নানা জটিলতার সম্মুখীন হন। কখনো কখনো মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যেও পড়ে তারা?
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘এন এক্সপ্লোরেটরি রিসার্চ অন ফেয়ার অব ভায়োলেন্স এমং গার্লস অ্যান্ড ইয়াং ওমেন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২০২১ সালের নভেম্বরে সারা দেশে এক জরিপ পরিচালনা করে। এ জরিপের তথ্যমতে জানা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৩৫ শতাংশের মতো যৌন হয়রানির ভয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। শহরের বস্তিগুলোতে মেয়েশিশু, কিশোরীরা যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। এ ঝুঁকির ফলে, ঢাকার বস্তিতে ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ের হার খুবই বেশি। ২৫.৬ শতাংশের মতে সামাজিক বিভাজনজনিত উদ্বেগের কারণে বাবা-মা মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন জেন্ডার অ্যান্ড স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, শহর বা গ্রামের সমাজব্যবস্থায় ভিন্ন রকমের পরিস্থিতি হলেও অভিভাবকদের একটা তাড়না থাকে ছেলের বিয়ের আগে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। এর কারণ তারা ভাবেন, বয়সকালে ছেলে তাদের দেখাশোনা করবে। এ ভাবনা থেকে ছেলের জন্য তারা যে বিনিয়োগ করে থাকেন মেয়ের বেলায় বেশিরভাগ অভিভাবক তা করেন না। একটি গবেষণায় দেখা যায়, মেয়েরা গ্রাম থেকে শহরে পোশাক কারখানায় কাজ করতে আসে তার ক্ষমতায়নের জন্য নয়। তারা কাজ করে বিয়ের যৌতুকের টাকা জোগাড়ের জন্য। যৌতুকের টাকা জমানো হলেই তারা বাড়ি ফিরে যায়। এভাবেই দেখা যায়, সামাজিক ব্যবস্থা একটি বিষয়ের সঙ্গে আরেকটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। এটা যে সামাজিক জটিলতার সৃষ্টি করে তা ধরা যায় না। এর কারণ বাল্যবিয়েকে বিষয়ভিত্তিক হিসাবে দেখা হয়। এ ক্ষেত্রে নানাবিধ বিষয় একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। যদিও সমাজ আমরা পরিবর্তন, পরিবর্ধন করছি পিতৃতন্ত্রের কিছু নিয়ামককে একই অবস্থায় রেখে। উন্নয়নের পাশাপাশি নিয়ামকগুলোও সক্রিয় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে একজন মেয়েকে ধর্ষণ বা দুজনে না বুঝে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে। গ্রাম, শহরে বিনোদনের অভাব হওয়ায় অল্প বয়সে তারা প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। মেয়ে গর্ভবতী হয়ে গেলে তখনি বাবা-মায়ের চিন্তাভাবনা শুরু হয় গর্ভবতী মেয়েকে নিয়ে। এর সঙ্গে বিয়ে না দিলে কেউ তার মেয়েকে বিয়ে করবে না। একজন নারীর জীবনের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায় তখনি।
তিনি আরও বলেন, মা-বাবার ভরণ-পোষণের জায়গায় মেয়েদেরও দায়িত্বশীল হিসাবে গড়ে তোলা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রথমত বাবা-মা মেয়েকেও সেভাবে গড়ে তুলবেন। দ্বিতীয়ত পুরুষতন্ত্রকে নতুন আঙ্গিকে দেখতে হবে। পুরুষতন্ত্র নারীর ক্ষেত্রে কতখানি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, পুরুষের ক্ষেত্রে কতখানি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা এখন বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
